Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মঞ্চে ওঠা থেকে রেহাই সচিবদের

পাঁচ দিনেই পরিবর্তন! গত বৃহস্পতিবার বোলপুরে সরকারি সাহায্য বিলির মঞ্চে অন্তত ১৮ জন আমলাকে তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে হাজির ছিলেন বীরভূমের দুই বিতর্কিত তৃণমূল নেতা দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। এই দুই নেতার বিরুদ্ধেই খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। এহেন তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে আমলাদের থাকতে বাধ্য করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

পাঁচ দিনেই পরিবর্তন!

গত বৃহস্পতিবার বোলপুরে সরকারি সাহায্য বিলির মঞ্চে অন্তত ১৮ জন আমলাকে তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে হাজির ছিলেন বীরভূমের দুই বিতর্কিত তৃণমূল নেতা দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। এই দুই নেতার বিরুদ্ধেই খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। এহেন তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে আমলাদের থাকতে বাধ্য করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর তার পরেই সোমবার এবং মঙ্গলবার পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুরের প্রকাশ্য সভায় আমলাদের মঞ্চে ডাকেননি মুখ্যমন্ত্রী। যদিও প্রশাসনিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অনেক আমলাই।

সরকারের নামে ডাকা আধা-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে আমলাদের আমজনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রথাটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করেছেন রাজ্যে ক্ষমতা দখলের ঠিক পরে পরেই। বিভিন্ন দফতরের আমলাদের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে তিনি জানতে চেয়েছেন, কোন প্রকল্পের কাজ কত দূর এগিয়েছে। আমলাদের দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতিও।

সে দিন ও এ দিন। (বাঁ দিকে) ১০ জুলাই ২০১৪। বোলপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় মনিরুল ইসলামের
(সাদা দাড়ি) সঙ্গে এক মঞ্চে গোপালকৃষ্ণ, সি এম বাচোয়াত, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ
একাধিক বিভাগীয় সচিব। (ডান দিকে) ১৫ জুলাই ২০১৪। কোলাঘাটের সভায় হাজির শুধু
মুখ্যসচিব (বসে ডান দিক থেকে দ্বিতীয়) ও স্বরাষ্ট্রসচিব (বসে বাঁ দিক থেকে প্রথম)। —নিজস্ব চিত্র

এ নিয়ে আমলা মহলে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। অনেক আমলারই বক্তব্য, তাঁরা জনপ্রতিনিধি নন। ফলে জনতার কাছে জবাবদিহি করার কাজ তাঁদের নয়। তাঁরা মন্ত্রীদের জবাব দিতে বাধ্য। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী জনসভায় অনেক সময়ই এমন কিছু বিষয় বা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যে সংশ্লিষ্ট আমলাকে বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যেতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান রক্ষায় আমলাদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিতে হয়েছে, এমন উদাহরণ বিরল নয়। এ ব্যাপারে ক্ষোভের কথা বিভিন্ন সময় মুখ্যসচিবের কানে তুলেওছেন একাধিক আমলা। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। ‘স্যার মনিরুলের’ সভায় আমলাদের উপস্থিতি নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ার পরে দু’টি সভায় হাজিরা থেকে ছাড় পেয়ে আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন তাঁদের অনেকেই।

আমলাদের একাংশের এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ প্রশাসনের একাংশ। তাদের পাল্টা বক্তব্য, আমলারা যদি জনতার কাছে দায়বদ্ধ না হন, তবে কার কাছে হবেন! মন্ত্রী আসেন যান, কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে আমলা বদল হন না। তা ছাড়া, জেলাশাসক বা ডিএমের মতো আমলাদের তো সরাসরিই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়। ফলে বিভিন্ন বিভাগীয় সচিবকে জনতার সামনে দাঁড় করানোর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বিভিন্ন জেলায় খয়রাতি বিতরণের সভায় এক প্রকার বাধ্যতামূলক ভাবেই উপস্থিত থাকতে হয় মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে। পশ্চিম এবং পূর্ব মেদিনীপুরের দু’টি সভাতেও মঞ্চে ছিলেন সঞ্জয় মিত্র, বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জিএমপি রেড্ডি। কিন্তু অন্য কোনও সচিবকে মঞ্চে ডাকেননি মুখ্যমন্ত্রী।

বিভিন্ন উন্নয়ন বৈঠকে হাজির থাকা একাধিক দফতরের সচিব জানাচ্ছেন, প্রকাশ্য মঞ্চে তাঁদের থাকার ব্যাপারটা পুরোপুরি নির্ভর করে মুখ্যমন্ত্রীর মর্জির উপরে। মুখ্যমন্ত্রী যে যে আমলাকে হাজির থাকতে বলেন, তাঁদের থাকতে হয়। যেমন, হাল আমলে বর্ধমানের বৈঠকে হাতে গোনা কয়েক জন সচিবকে থাকতে বলেছিলেন তিনি। হুগলিতেও তেমনটাই হয়েছিল। আবার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ির প্রশাসনিক বৈঠকে সমস্ত সচিবকে মঞ্চে থাকার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বোলপুরে মঞ্চে হাজির থাকা সচিবদেরও অনেকে জানাচ্ছেন, সে দিন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, তাই থাকতে হয়েছিল।

মমতার জেলা সফরে সাধারণ ভাবে প্রথমে বন্ধ ঘরে বিভিন্ন প্রকল্পের পর্যালোচনা হয়। সেখানে জেলার অফিসারদের সঙ্গে দফতরের সচিবদের থাকাটা দস্তুর। সেই প্রশাসনিক বৈঠকের পর তিনি প্রকাশ্য সভায় নানা প্রকল্পের শিলান্যাস-উদ্বোধন করেন। মুরগির ছানা, মাছের পোনা থেকে সাইকেল, সেলাই কল নানা জিনিস বিলি করেন। তার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ মঞ্চে হাজির কোনও আমলাকে নির্দেশ দেন বিভিন্ন প্রকল্পের ফিরিস্তি দেওয়ার।

কিন্তু দুই মেদিনীপুরেই মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছানুসারে প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে প্রকাশ্য সভার পরে। সোমবার মেদিনীপুর বা মঙ্গলবার কোলাঘাটে বিভাগীয় আমলারা পৌঁছেছেন প্রকাশ্য সভা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে।

মুখ্যমন্ত্রী কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে আমলা মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, বোলপুরের সভা ঘিরে সমালোচনার জেরেই এই ব্যবস্থা বদল। তাতে ঘুরপথে হলেও আমলাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ খানিকটা নিরসন হয়েছে। এ ভাবে আমজনতার সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করাটা যে আমলাদের পক্ষে অস্বস্তিকর, সেটা হয়তো বুঝতেও পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

আমলাদের অন্য একটি অংশ অবশ্য এতটা আশাবাদী নন। তাঁদের মতে, দুই মেদিনীপুরে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ডাকলেন না বলেই যে প্রথাটা বিলোপ হয়ে গেল, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। আজ বুধবার থেকে তাঁর উত্তরবঙ্গ সফর শুরু হচ্ছে। সেখানেই হয়তো আবার মঞ্চে ডাক পড়বে আমলাদের। মেদিনীপুর ব্যতিক্রম হল কেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই আমলাদের অনেকে বলছেন, মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে শাসক দলের মধ্যেই চোরাস্রোত রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তাই এখানে মন্ত্রী-সান্ত্রী-পারিষদদের হাজির করে জাঁকজমকের সঙ্গে সরকারের উপস্থিতি জানান দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে তুলনায় পিছিয়ে থাকা উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষকে কাছে টানতে অতীতেও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মমতা। তার অঙ্গ হিসেবে এ বারও প্রশাসনকে তাঁদের সামনে হাজির করতে পারেন তিনি।

এই ধরনের অনুষ্ঠানে হাজির থাকার ব্যাপারে আমলাদের আপত্তির আর একটা বড় কারণ হল, সরকারের নামে ডাকা হলেও কার্যত সেগুলি রাজনৈতিক চেহারা নিয়ে নেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আমলার কথায়, “এই ধরনের জনসভায় শুধুমাত্র শাসক দলের জনপ্রতিনিধিরা থাকেন। বিরোধী দলের কাউকে ডাকা হয় না। উপস্থিত জনতাও মূলত শাসক দলের সমর্থক। তাঁদের হাতেই সাইকেল, জমির পাট্টা বা অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা তুলে দেওয়া হয়। ফলে সেখানে আমাদের উপস্থিত থাকলে এটা মনে হতে পারে যে আমলারা শুধু শাসক দলের জন্যই।”

আমলাদের একটা অংশ অবশ্য বলছে, এ ধরনের সব বৈঠকেই যে হাজির থাকতে হবে, তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ইচ্ছে করলেই অনুষ্ঠানে থাকা এড়িয়ে যাওয়া যায়। এক আমলার কথায়, “গত তিন বছরে মুখ্যমন্ত্রী জেলায় ৬৫টি সভা করেছেন। আমি সাত-আটটির বেশি সভায় থাকিনি। যে সব সভা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, সেখানে থেকেছি।” যদিও আর এক আমলার বক্তব্য, “ব্যাপারটা মোটেই এত সহজ নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সভায় নিজের মর্জিমাফিক থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় নাকি! মুখ্যমন্ত্রী চাইলে সচিবরা যে কোনও জায়গায় উপস্থিত থাকতে বাধ্য।”

জেলায় জেলায় এই ধরনের অনুষ্ঠান নিয়ে আরও একটা প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের একাধিক কর্তা। তাঁরা বলছেন, এই ধরনের বৈঠক করতে গেলে মঞ্চ বাঁধা থেকে আমলাদের থাকা-খাওয়া, সব নিয়ে ভাল পরিমাণ টাকা খরচ হয়। সে টাকার ব্যবস্থা করতে হয় সংশ্লিষ্ট জেলাশাসককেই। এর জন্য কোনও পরিকল্পিত বাজেট থাকে না। অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের টাকা থেকেই অর্থের সংস্থান করতে হয়। যা সরকারি ভাবে অনুচিত বলেই অনেকের মত।

তবে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, বেড়ালের গলার ঘণ্টাটা বাঁধবে কে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE