শমিবার এসপ্ল্যানেড চত্বরে তৃণমূলের মিছিল। —নিজস্ব চিত্র
শুরুতেই সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতারের প্রতিবাদে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে অবস্থান। ফলে একটা দাগ রাখার দায় ছিলই। শনিবার দুপুর একটায় কর্মসূচির শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া হল, ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচে অবস্থান চলবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
কিন্তু বাঁধন শক্ত করেও গেরোটা ফস্কাই হল! সমর্থকরা তো বটেই, আড়াইটে বাজতেই অবস্থান মঞ্চ শুনশান। যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের কথাতেই স্পষ্ট, কেন এসেছিলেন জানেন না। টুম্পাই গ্রেফতারের পরে শিল্পীদের মিছিলেও ঠিক এই ছবিটাই দেখা গিয়েছিল।
কেন? বক্তা যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে এই হাল কেন? জবাব পেতে অবশ্য বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রতিবাদ অবস্থানে হাজির হওয়া তৃণমূল সমর্থকদের অনেকেই বলেছেন, ভিড় হবে কী করে, মদনদাই তো নেই!
বরাবরই তৃণমূলের হঠাৎ ডাকা সভায় ভিড় জমানোয় বড় ভরসা মদন। সারদার খাঁড়া মাথায় নিয়েই মাস কয়েক আগে দলের ট্রেড ইউনিয়নের মিছিলে ভিড় জমাতে উদ্যোগী হতে হয়েছিল তাঁকেই। মন্ত্রীর অ্যান্টি-চেম্বারে এসে লোক আনতে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন তৃণমূলের এক শীর্ষ ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী। এমনকী, গত মাসে তৃণমূলপন্থী বিশিষ্ট জনদের মিছিলের লোক জুগিয়ে মান বাঁচানোর দায়িত্বও পড়েছিল মদনের কাঁধে। দলনেত্রীর নির্দেশ পেয়ে তাই হাসপাতালে বসেই মিছিলে লোক আনতে উদ্যোগী হন মদন। অথচ তাঁকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এ দিনের অবস্থানে বড় জোর হাজার তিনেক লোক!
জমায়েতের জন্য তৃণমূল দ্বিতীয় যে ব্যক্তির উপরে ভরসা করে, সেই মুকুল রায়ও নেই। এ দিনের অবস্থানে তো ছিলেনই না, বেশ কিছু দিন ধরেই দলের প্রকাশ্য কমর্সূচিগুলিতে কার্যত অনুপস্থিত তিনি। ভিড় জমানোর লোকেরা নেই, তাই ভিড়ও নেই। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোনোর সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মদন বলেন, “বাংলার মানুষ, যাঁরা আমার জন্য পথে নেমেছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।”
মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সম্ভবত তা খেয়াল করেছেন। তাই মঞ্চে হাজির প্রাক্তন ফুটবলারদের উদ্দেশে মন্তব্য করেন, “আপনারা সব ক্লাবকে বলুন, সোমবার এখানে এসে অবস্থান করতে।” কারণও ব্যাখ্যা করেন তিনি। বলেন, “টুম্পাই মোহনবাগান ক্লাবের লোক। মোহনবাগানের অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। সমর্থকেরা কোথায়? আমি বলব, ওদের রাস্তায় নামতে।” ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান-সহ ময়দানের সব ক্লাবের জন্যও একই বার্তা মমতার। মহমেডানের ঘরের ছেলে দীপেন্দু বিশ্বাস পাশ থেকে জানান, ওই দলের কোচ ও খেলোয়াড়রা হাজির হন।
টুম্পাই, মদন ময়দানের সঙ্গে যুক্ত দু’জনকেই এ দিন দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “টুম্পাইয়ের বিরুদ্ধে কী বলছে? ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি। টুম্পাই জীবনে কাউকে চড় মারতে পারে না। সে নাকি ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি করছে!” আর মদন? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “মদন চোর, এটা আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই। যদি বলেন, মদন কোনও একটা পুজো কমিটিতে গেছে, আমি বিশ্বাস করব। যদি বলেন, কোনও ক্লাবের জন্য কাউকে বলেছে, ওকে পাঁচ লাখ টাকা দিন, আমি বিশ্বাস করব। যদি বলেন, একটা খেলোয়াড় খেলতে পারছে না, তাকে স্পনসর করতে বলেছে, আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, মদনের এত দুঃখ হয়নি, এত কিছু অভাব নেই যে, সারদার টাকায় ও ঘরের বউ-বাচ্চাদের খাওয়াবে।”
এ দিন নবান্ন যাওয়ার পথে হঠাৎই প্রতিবাদ সভায় হাজির হন মমতা। অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়ে গিয়েছে তার ঘণ্টাখানেক আগে। কিন্তু ঠাসবুনোট ভিড় যে নেই, যেটুকু রয়েছে, তাতেও স্পন্দনের অভাব অভিজ্ঞ রাজনীতিক মমতার তা বুঝতে ভুল হয়নি। পরিবহণ মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ভিড় জমানোর দায়িত্ব বর্তেছিল মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনের ছায়াসঙ্গী প্রশান্ত প্রামাণিকদের উপরে। কিন্তু এঁরা সবাই মিলেও হেরে গিয়েছেন। মঞ্চে মমতা ছাড়াও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, প্রবীণ নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তবুও ভিড় নেই।
এমনকী, যে খেলার মাঠের লোকেদের নিয়ে সভা, তাঁদেরও বেশির ভাগই গরহাজির! তৃণমূল শিবিরে পরিচিত মুখ চুনী গোস্বামী, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নইমুদ্দিন, সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমা বিশ্বাস, জয়দীপ কর্মকার দেখা গেল না কাউকেই। এমনকী, মদন-ঘনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে পরিচিত কম্পটন দত্ত, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়কেও খুঁজে পাওয়া গেল না গৌতম-প্রশান্ত-শ্যাম থাপাদের পাশে।
তবে খেলোয়াড় জীবনের মতোই দক্ষ ড্রিবল করে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে পৌঁছে গিয়েছেন গৌতম সরকার। সিবিআই এবং বিজেপি-র বিরুদ্ধে এ দিন তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সরব। বলেন, “আমাদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, যাতে এই সভা করতে না পারি। কিন্তু আমরা এসেছি, স্বেচ্ছায়, ভালবাসায়। যত দিন না মদন মিত্রকে ছাড়া হবে, প্রতিবাদ চলবে।” গৌতমবাবুকে ছাপিয়ে প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মদন মিত্রকে গ্রেফতার করা হলে, আমাদেরও গ্রেফতার করা হোক।”
অবস্থান মঞ্চে এ দিন সবাই মদনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দীপেন্দু যেমন বলছিলেন, “বসিরহাটে দু’জন গরিব বাচ্চার ক্যানসার ধরা পড়েছিল। যখন মদনদাকে বললাম, ওদের চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার তখন উনি একটা ফুটবল ম্যাচ করতে বলেন বসিরহাটে। কিন্তু টিকিট বিক্রির টাকা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মদনদা নিজের আংটি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল।” ‘দাদা’ গ্রেফতার হয়েছেন শুনে দিল্লি যাওয়া বাতিল করে অবস্থানে আসেন রাইফেল শু্যটার মাম্পি দাস।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান সত্ত্বেও খেলোয়াড়দের গরহাজিরার তালিকাটাই দীর্ঘ ছিল। কেন? বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “তৃণমূল অনুগামী গুটিকয়েক খেলোয়াড় ছাড়া কেউ ওখানে যাননি। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, ওই জমায়েতে যাওয়া মানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy