Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মন্ত্রী ঝিমিয়ে, অনুগামীদের তাণ্ডব কোর্টের ভিতর-বাইরে

দলের বিপদে ভিড় টানতে বার বার ‘ত্রাতা মধূসূদন’ হতে হয়েছে তাঁকে। এ বার ঘোর দূর্দিনে আদালতের ভিতরে, বাইরে দলও সারা ক্ষণ ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে সেঁটে থাকল। শনিবার বিকেলে আলিপুর কোর্ট-চত্বরের বাইরে মদন মিত্রকে নিয়ে সিবিআইয়ের গাড়ি ঢুকতেই ঝাঁঝালো স্লোগান উঠেছে। ‘মদন তুমি জেনে রেখো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি!’ কিংবা ‘মদন তুমি জেনে রেখো, দিদি তোমার সঙ্গে আছে।’ আর এজলাসের ভিতরে শাসক দলের অনুগত আইনজীবী-বাহিনী দফায় দফায় গলার জোরে বাকিদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে।

গাড়িতে ধৃত মন্ত্রী। আলিপুর আদালতের সামনে মদনের অনুগামীদের চিৎকার-স্লোগানে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। শনিবার।

গাড়িতে ধৃত মন্ত্রী। আলিপুর আদালতের সামনে মদনের অনুগামীদের চিৎকার-স্লোগানে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। শনিবার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

দলের বিপদে ভিড় টানতে বার বার ‘ত্রাতা মধূসূদন’ হতে হয়েছে তাঁকে। এ বার ঘোর দূর্দিনে আদালতের ভিতরে, বাইরে দলও সারা ক্ষণ ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে সেঁটে থাকল।

শনিবার বিকেলে আলিপুর কোর্ট-চত্বরের বাইরে মদন মিত্রকে নিয়ে সিবিআইয়ের গাড়ি ঢুকতেই ঝাঁঝালো স্লোগান উঠেছে। ‘মদন তুমি জেনে রেখো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি!’ কিংবা ‘মদন তুমি জেনে রেখো, দিদি তোমার সঙ্গে আছে।’ আর এজলাসের ভিতরে শাসক দলের অনুগত আইনজীবী-বাহিনী দফায় দফায় গলার জোরে বাকিদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে।

শাসক দলের ‘মদনসেনা’দের এই তাণ্ডবের সামনে পুলিশ-প্রশাসনের দিশাহারা চেহারাটাও বার বার বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। বিকেল পৌনে তিনটে নাগাদ আলিপুর কোর্টমুখী সাদা ঢাউস গাড়িটা আলিপুর থানার সামনে এসেই কার্যত থমকে গিয়েছিল। সমর্থকদের ভিড় ঠেলে ব্যাজারমুখের বন্দি মন্ত্রীকে নিয়ে কয়েক পা দূরে কোর্ট-চত্বরে ঢুকতেই মিনিট কুড়ি লেগে গেল পুলিশের। দু’দফায় ভিড় ঠেলে কোর্টে যাওয়া-আসার পরে দেখা গেল, ভিভিআইপি বন্দিকে নিয়ে যাওয়া সিবিআইয়ের গাড়ির লাল বাতি উধাও, লুকিং-গ্লাস ক্ষতবিক্ষত। মদনের পিছু-পিছু ঢোকা সুদীপ্ত সেনের আইনজীবী নরেশ ভালোড়িয়ার গাড়ির কাচেও চিড় ধরেছে।

দিন কয়েক আগেই শাসক দলের নেতা-কর্মীদের দাপটে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করে মুখ পুড়িয়েছিল আলিপুর থানার পুলিশ। এ দিনও আলিপুর থানার সামনেই তৃণমূলের পেশির জোর কাকে বলে আক্ষরিক অর্থেই টের পেল পুলিশ। রাখঢাক না-করে ভিড়ের সঙ্গে ছিল শাসক দলের পতাকা। পুলিশকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে বন্দি মন্ত্রীর গাড়িতে দমাদ্দম বাড়ি পড়তে শুরু করে এক সময়। থানা স্তরের এক পুলিশকর্তা পরে বলেছেন, “মদন-হরণ পালা চলছিল মনে হচ্ছে!” কোর্ট-প্রাঙ্গণের ঠিক বাইরে পুলিশের গার্ডরেল উল্টে তাণ্ডবও চলে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। তার সঙ্গে ‘ফাউ প্রাপ্তি’ চোখা-চোখা গালাগাল। এমনকী, ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ প্রকৃতিস্থ দশায় ছিলেন না বলেও জানান পুলিশের একাংশ।

যুদ্ধং দেহি মেজাজের এই মদন-সমর্থকদের অনেককেই কোর্ট-চত্বরের বাইরেও ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। পুলিশকে পাত্তা না দিয়ে ভিতরে ঢুকে এজলাসে তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের পিছনে তাঁরাও ভিড় জমিয়েছেন। শাসক দলের অনুগত আইনজীবীরা কখনও দাবি করেছেন, শুনানির সময়ে সংবাদমাধ্যমকে বার করে দিতে হবে। বিচারক ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩২৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী শুনানি প্রকাশ্যে হবে বলে জানিয়ে দিলে তাঁরা আবদার করেন, কোর্ট ইনস্পেক্টরকে দিয়ে বাইরে জড়ো হয়ে থাকা আরও ক’জন আইনজীবীকে ভিতরে ঢোকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। হই-হট্টগোলের মধ্যে বিচারক এক বার কিছু ক্ষণের জন্য এজলাসের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থসারথি দত্তকেও সওয়াল করতে উঠে মন্ত্রীর অনুগত আইনজীবীদের গলাবাজির সামনে বার বার ঠোক্কর খেতে হয়েছে।

তৃণমূল সূত্রের খবর, মন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র কামারহাটিতে স্থানীয় পুরচেয়ারম্যান ও মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক মিলেই আলোচনা করে মদন সমর্থকদের নামানোর ঘুঁটি সাজান। পরিবহণ কর্মীদের মধ্যে থেকেও লোক জড়ো করা হয়। মদন গ্রেফতার হওয়ার সন্ধেয় সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআইয়ের দফতরে ভিড় ততটা জমেনি। এ দিন কিন্তু দেখা যায়, ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচের ভিড়টা ক্রমশ আলিপুর কোর্টের বাইরে জাঁকিয়ে বসেছে। আদালতে হাজিরা দিয়ে মদন সিজিও কমপ্লেক্সে ফিরে আসার পরে সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ কামারহাটি থেকে তিন-চার গাড়ি মদনভক্ত সেখানেও জড়ো হন। ম্যাটাডরের গায়ে ‘দাদা’র ছবি-সংবলিত ফেস্টুন, ‘তুমি মদন মিত্র, আমরা তোমার পাশে আছি।’

মেঠো নেতা মদন বরাবরই সাধারণ লোকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁকে নিয়ে দলের তরফে এমন সংগঠিত হুঙ্কার সম্ভবত তিনি নিজেও কোনও দিন দেখেননি। ভিভিআইপি বন্দিকে নিয়ে সিবিআইয়ের গাড়ি আলিপুর কোর্টের পাড়ায় ঢুকতেই ভিড়ের পুষ্পবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়া সুরে স্লোগানের ভোকাল টনিক।

কিন্তু এ মদন যেন সে মদন নয়। কিছুই তাঁকে সে-ভাবে জাগাতে পারল না। কোর্ট-চত্বরে ঢোকার আগে তাঁর হেঁটমাথা এক বারটি কোনওমতে তুলেছিলেন মন্ত্রী। কনুইটা সামান্য মুড়ে জনতার অভিবাদন নিতে তাঁর ডান হাতটা কয়েক মুহূর্তের জন্য উপরে ওঠে। তার পরেই ফের কাঁধ ঝুলে যায় মন্ত্রীর। তবে কোর্টে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময়ে গাড়ির বাইরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে অনুগামীদের সঙ্গে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করেন মদন।

সিবিআইয়ের গাড়িতে জনতার তাণ্ডবে বরং কিছুটা অস্বস্তিই ফুটে উঠছিল মন্ত্রীর চোখেমুখে। বিশেষত, বিকেলে কোর্টে যাওয়ার সময়ে। গাড়ির মাঝের সিটে সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের মাঝখানে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে বসেছিলেন মন্ত্রী। আলিপুর থানা ছাড়িয়ে একটু এগিয়েই গাড়ি একেবারে থমকে যায়। জনস্রোতের মুখে এগোতে না-পেরে সিবিআইয়ের গাড়ির চালক এক সময়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে দেন। গাড়ির গায়ে-পড়া জনতাকে সরিয়ে অগত্যা রথ টানার মতো গাড়ি ধরে টানতে শুরু করে পুলিশ। পিছন থেকেও গাড়ি ঠেলতে থাকেন পুলিশকর্মীরা। এই ভাবে কার্যত ধাক্কা দিয়েই গাড়িটা আলিপুর কোর্টের গেট অবধি নিয়ে যায় পুলিশ। বিকেল তিনটে দশ মিনিট নাগাদ গেট পেরিয়ে মন্ত্রীর গাড়ি কোর্ট-চত্বরে ঢুকে যায়।


মদন-অনুরাগীদের বিক্ষোভে কাচ ভাঙল পুলিশের গাড়ির। মন্ত্রীকে নিয়ে আলিপুর আদালত থেকে ফেরার পথে।

মন্ত্রীর গাড়ির সঙ্গেই কেউ কেউ ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। যারা ঢুকতে পারলেন না, এর পরে তাঁদের তোপের মুখে পড়ে পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম। কোর্টের গেটের মুখে পুলিশের গার্ডরেল আছড়ে ফেলে তাণ্ডব শুরু হয়। হিংস্র ভঙ্গিতে সাংবাদিকদের তাড়া করে জনতা। ক্যামেরাধারীদের তাড়া করে আলিপুর থানার গেটের দিকে চলে যায় জনতা। পুলিশ ভাবে, ফের বুঝি আলিপুর থানায় ঢুকতে চলেছে শাসক দলের উন্মত্ত জনতা। এ যাত্রা থানার গেট বন্ধ করে তৃণমূল সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশকে যুঝতে হয়। মদনকে কোর্ট থেকে বার করার পরেও বিধাননগর পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে জনতা। ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মার দিকেও তেড়ে যান শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা।

এ দিন সকালের দিকটা অবশ্য কিছুটা শান্তিপূর্ণ ভাবেই সহাবস্থান করছিলেন পুলিশ ও শাসক দলে কর্মী-সমর্থকেরা। বেলা ১১টা নাগাদই মদনের আসার প্রস্তুতিতে আলিপুর কোর্টের ফটক আগলে দাঁড়ায় পুলিশ। তখন প্রতীকী প্রতিবাদের কথা বলে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা হাতে হাত দিয়ে মানব-শৃঙ্খল করেছেন। আলিপুর কোর্ট থেকে ভবানী ভবন অবধি রাস্তা জুড়ে হাতে হাত দিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সরু ফাঁক দিয়ে থেমে থেমে গাড়ি চলছে।

মদনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েক জনকে চোখের জল মুছতেও দেখা যায়। পরিবহণ ভবনের চেনা মুখ মাথায় ফেট্টি বাঁধা এক যুবক শক্ত করে পুলিশের গার্ডরেল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। তিনি অস্ফুটে বলেন, “মদনদা আমায় রাস্তা থেকে তুলে দাঁড় করিয়েছেন।”

ভিড়ের এই শান্ত মেজাজটা কিন্তু বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মদনকে নিয়ে সিবিআইয়ের গাড়ি ওই তল্লাটে আসতে তো রীতিমতো জঙ্গি মেজাজ। পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির কাছে এসে তখন প্রায় ‘মন্ত্রী-লুঠের’ উপক্রম। বিজেপিকে বিঁধে স্লোগান ওঠে ‘নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, রাহুল সিংহ ধাপ্পাবাজ, দূর হটো’। সিবিআইয়ের উদ্দেশে, ‘সিবিআই চামড়া তোমার গুটিয়ে নেব।’ কখনও বা সমস্বরে শোনা গিয়েছে। ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে মদন মিত্র জিন্দাবাদ’। বা ‘আমার নেতা তোমার নেতা মদন মিত্রকে আটকে রাখা যাবে না।’ মদন আদালতে ঢুকে পড়ার পরে ওই তল্লাট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তথা যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গায়ক ইন্দ্রনীল সেন এক বার ঘুরে যান।

কোর্টপর্ব চুকিয়ে মদন ফেরার সময়ে এক সমর্থক একটা পোস্টার উঁচিয়ে গাড়ির সামনে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘সিবিআইয়ের খাঁচা বাঘকে ধরে রাখতে যথেষ্ট নয়।’ খাঁচা-বন্দি মন্ত্রী তবু ঝিমিয়েই থেকেছেন। তাঁর জন্য পথে নামা জনতাকে উদ্দীপ্ত করার মতো কিছু সংলাপও দিতে পারেননি তিনি।

তবে রাত সওয়া আটটার পরে মদনকে সিবিআইয়ের দফতর থেকে বের করে সল্টলেকের ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানায় (সেখানেই এখন মন্ত্রীর রাত্রিবাসের আয়োজন) নিয়ে যাওয়ার সময়ে অপেক্ষাকৃত কম বিধ্বস্ত দেখিয়েছে তাঁকে। চুল পাট করে আঁচড়ে খানিকটা ফিটফাট-দর্শন মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য থেমে যান। ধৃত কুণাল ঘোষ বা আসিফ খানরা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশ যেমন নানা কৌশলে বাধা দেয়, মদনের ক্ষেত্রে অবশ্য সে-সব করা হয়নি।

একটু থমকে মন্ত্রী তাঁর দিনশেষের ‘ভোট অফ থ্যাঙ্কস’ জানিয়েছেন। ‘বাংলার মানুষ, যাঁরা আমার জন্য পথে নেমেছেন তাঁদের ধন্যবাদ! কোর্ট এবং বারের সদস্যদের ধন্যবাদ! আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই!’ ডাকাবুকো নেতার কাছ থেকে আর কোনও ধারালো সংলাপ পাওয়া যায়নি।

ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স থানায় মন্ত্রীকে তাঁর বর্তমান নৈশাবাসে নিয়ে যাওয়ার পরেও বাইরে নিজেদের ডিউটি বহাল রেখেছেন ম্যাটাডর-বোঝাই মদনসেনা-র দল।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madan mitra cbi arrest saradha scam tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE