ভাঁড়ারে মা ভবানী। টানাটানির সংসারে কর্মচারীদের বিস্তর ডিএ বকেয়া। তারই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর আকাশ বিহারের পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের যৌক্তিকতা নিয়ে ধন্দে পড়েছে খাস প্রশাসনের একাংশ।
চলতি সপ্তাহে চার শহরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টার সফরের প্রেক্ষিতে সংশয় আরও জোরালো। “যেখানে অনেক, অনেক কম খরচে গাড়ি চড়ে অনায়াসে যাওয়া যায়, সেখানে কপ্টারে যাওয়ার যুক্তিটা কী?” প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নবান্নের অন্দরে। যাত্রী-পরিষেবার নামে নেওয়া কপ্টারটিতে যেখানে যাত্রী-ই অমিল, সেখানে তার পিছনে ফি মাসে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ভাড়া গোনার উদ্দেশ্য নিয়েও বিভ্রান্ত প্রশাসনের এই মহল।
গত সোম থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী কপ্টারে গিয়েছেন দক্ষিণবঙ্গেরই চারটি শহরে বনগাঁ, দিঘা, হলদিয়া ও দুর্গাপুর (আকাশপথে অন্ডাল পর্যন্ত)। কলকাতা থেকে সড়কপথে ওই চার জায়গায় যাতায়াত করলে শ’সাতেক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। আধিকারিকদের হিসেবে, আরামদায়ক বড় গাড়ি নিলে সে ক্ষেত্রে বড় জোর ২৮ হাজার টাকা লাগত। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টারের ভাড়া গুনতে হয়েছে ২৩ গুণ বেশি অন্তত সাড়ে ছ’লাখ টাকা। তবে ঘণ্টা-কিলোমিটার হিসেবে সাতশো কিলোমিটার চপার-যাত্রার খরচ সাড়ে ছ’লাখ হলেও আসল খরচটা কত, সে-ও একটা ধাঁধা। কী রকম?
এক পরিবহণ-কর্তার দাবি, এখানে খরচটা ৫০ লাখই ধরতে হবে। কারণ পবনহংস থেকে মাসে পঞ্চাশ লক্ষ টাকায় ভাড়া নেওয়া ওই কপ্টারে হাতেগোনা যাত্রী হলেও মূলত মুখ্যমন্ত্রীই তা ব্যবহার করেন। এমনকী, এখন ৮০ কিলোমিটার দূরের বনগাঁতেও কপ্টারে যাতায়াত করেন। বলতে গেলে, তাঁর ‘আকাশ ভ্রমণ’ খাতেই মাসে মাসে ওই পঞ্চাশ লক্ষের খরচ বাঁধা হয়ে গিয়েছে কোষাগারে।
এ রেওয়াজেরই যৌক্তিকতা এখন প্রশ্নের মুখে। বিশেষত এ সপ্তাহের ঘটনার পরে নবান্নের আধিকারিকদের অনেকে বলছেন, বনগাঁ, দিঘা, হলদিয়া বা দুর্গাপুর কোথাও যাতায়াতের রাস্তা খারাপ নয়। সামনে-পিছনে পুলিশের লম্বা কনভয় নিয়ে কোথাও পৌঁছতে বেশি সময় লাগারও কথা নয়। “তা হলে কী এমন জরুরি ছিল যে, চার শহরেই কপ্টারে চড়ে যেতে হল?” বিস্মিত তাঁরা। কেউ কেউ মনে করাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বহু জেলা সফর করলেও কপ্টারে সওয়ার হননি।
পরিবহণ দফতরের খবর: রাজ্য মাসে চল্লিশ ঘণ্টা হিসেবে পবনহংসের আট আসনের কপ্টারটি ভাড়া নিয়েছে বছরখানেক আগে। ঠিক হয়, কলকাতা থেকে সেটি যাত্রী নিয়ে মালদহ, বালুরঘাট, দুর্গাপুর, হলদিয়া, গঙ্গাসাগর, শান্তিনিকেতনে যাতায়াত করবে। সপ্তাহে এক দিন মালদহ-বালুরঘাট-শান্তিনিকেতন রুটে, দু’দিন দুর্গাপুরে, হলদিয়ায় দু’সপ্তাহে এক দিন, এবং দরকার মতো গঙ্গাসাগরে। ভাড়াও ঠিক হয়ে যায় মালদহ ১৩০০ টাকা, বালুরঘাট-হলদিয়া-দুর্গাপুর-শান্তিনিকেতন-গঙ্গাসাগর ১৫০০।
তবে সরকারি কর্তারা অঙ্ক কষে দেখেছেন, কপ্টার যদি পুরো যাত্রী নিয়ে ছ’রুটে নিয়মিত যাতায়াত করে, তা হলেও মাসিক পঞ্চাশ লাখ ভাড়ার পাঁচ শতাংশের বেশি উঠবে না। উপরন্তু যাত্রী তেমন মিলছে না। টিকিটের দাম কম রেখে লাভ হয়নি। ঠিক হয়, রাজ্য কপ্টারটি ভাড়া দেবে ঘণ্টাপিছু দু’লক্ষ টাকায়। সে পরিকল্পনাও ফেল মেরেছে। রাজ্য অর্থ দফতরের কিছু কর্তার বক্তব্য, এমনটা যে হবে, গোড়াতেই জানা ছিল। “শিল্প বলুন বা পর্যটন দুই মানচিত্রেই পশ্চিমবঙ্গকে খুঁজতে এখন আতসকাচ দরকার। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কপ্টারে চড়ার লোক মিলবে কী করে?” মন্তব্য এক কর্তার।
ফলে এক বছরে কপ্টারের পিছনে সরকারকে ভাড়া গুনতে হয়েছে ছ’কোটি টাকা। যাত্রী-ভাড়া বাবদ আদায় সাকুল্যে কয়েক লক্ষ। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এত টাকা ভর্তুকি দিয়ে কপ্টার রাখার প্রয়োজন কী? যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সরকারি কর্তাদের একাংশ একান্তে বলছেন, আসলে মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই কপ্টার মজুত রাখা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও ইদানীং হামেশা আকাশ-যানে সওয়ার হচ্ছেন। চলতি মাসে অতি সামান্য ক’জন যাত্রীকে বাদ দিলে কপ্টারে সওয়ার হয়েছেন এক জনই মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। নবান্নের অন্য মহলের যুক্তি, এতে মুখ্যমন্ত্রীর সময় বাঁচছে।
কিন্তু এই টুকুর জন্য ফি মাসে আধ কোটি টাকা যথেষ্ট চড়া মূল্য নয় কি? যেখানে কোষাগারের দৈন্যদশা নিয়ে সরকারেরই নিত্যদিন খেদের শেষ নেই?
এর সদুত্তর মেলেনি। বাম আমলে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মাঝে-মধ্যে কপ্টারে জেলা সফর করেছেন। মমতা-সহ বিরোধীরা তখন তার কম সমালোচনা করেননি। এখন উল্টো ছবি দেখে নবান্নের অনাচে-কানাচে গুঞ্জন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কপ্টার ভাড়া দিয়ে পবনহংস-ও ফাঁপরে পড়েছে। সংস্থার এক কর্তা জানান, আন্দামানে তাঁদের কপ্টার মাসে ১১০ ঘণ্টা ভাড়া খাটছে। অরুণাচলপ্রদেশে মাসে গড়ে ৮০ ঘণ্টা, এমনকী আইজলেও ৭০ ঘণ্টার ভাড়া মিলছে। সে জায়গায় পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৪০ ঘণ্টা! “কপ্টারটি অন্যত্র ভাড়া দিয়ে বেশি আয়ের সুযোগ থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না।’’ আক্ষেপ করছেন তিনি। ওঁর দাবি, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়, নির্ধারিত চল্লিশ ঘণ্টার বাইরেও ভাড়া পাওয়া যাবে। পাওয়া যায়নি।”
এই অবস্থায় নতুন বছরে ভাড়া বাড়ানোর কথা ভাবছেন পবনহংস কর্তৃপক্ষ। শুনে সরকারি কর্মীদের কারও কারও কটাক্ষ, “কর্মীদের ডিএ বাকি রাখলেও কপ্টারের বাড়তি ভাড়া গুনতে বোধহয় সরকার আপত্তি করবে না। কারণ, ওটা তো মুখ্যমন্ত্রীর জন্য!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy