Advertisement
E-Paper

শুভেন্দুর ইঙ্গিতে ঝড়, ফের সামনে রিগিং-তত্ত্ব

যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি পদ থেকে সদ্য অপসারিত সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। শাসক দলের প্রথম সারির সাংসদের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে লোকসভা ভোটে রিগিং-তত্ত্বকেই ফের সামনে এনেছে বিরোধীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৪ ০৩:০৩
বিদ্যাসাগর ব্যাঙ্কে শুভেন্দু অধিকারী। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

বিদ্যাসাগর ব্যাঙ্কে শুভেন্দু অধিকারী। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি পদ থেকে সদ্য অপসারিত সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। শাসক দলের প্রথম সারির সাংসদের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে লোকসভা ভোটে রিগিং-তত্ত্বকেই ফের সামনে এনেছে বিরোধীরা। শুভেন্দু অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, তাঁর দলের প্রার্থীরা রিগিং করে জিতেছেন, এমন কথা তিনি বলতে চাননি। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে অস্বস্তি এতে বিন্দুমাত্র কমেনি।

শুক্রবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুব সভাপতির পদ থেকে শুভেন্দুকে সরিয়ে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসে সদ্য সাংসদ হওয়া সৌমিত্র খাঁর নাম ঘোষণা করেছিলেন। তার পরেই শনিবার তাঁর নিজের লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত নন্দকুমারে প্রথম প্রকাশ্য সভায় শুভেন্দু বলেন, “আমাদের অনেকেই অনেক ভোটে জিতেছেন। আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তাঁরা কী কায়দায় ভোট করেছেন, কী কায়দায় জিতেছেন, আমরা জানি! গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁদের এলাকায় কত ভোটের ব্যবধান ছিল, তা-ও জানি!”

এ বার গোটা রাজ্যে ৩৯% ভোট পেয়ে ৩৪টি লোকসভা আসন পেয়েছে তৃণমূল। চতুর্মুখী লড়াই সত্ত্বেও বহু আসনে তৃণমূল প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন বিরাট ব্যবধানে। বিভিন্ন লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটি বা দু’টি বিধানসভা এলাকা ধরে শাসক দল যে ‘অস্বাভাবিক’ লিড পেয়েছে এবং তার ফলেই যে জয়ের রাস্তা সুগম হয়েছে, বুথভিত্তিক ভোটের পরিসংখ্যান থেকেই এমন অভিযোগ উঠে আসছিল। শুভেন্দুর সাম্প্রতিক মন্তব্য সেই অভিযোগকেই আরও জোরালো করেছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “ ‘কে কী ভাবে অনেক ভোটে জিতেছেন, আমরা জানি’ বলে শাসক দলের সাংসদই তো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছেন! আমরা হিসেব হাতে নিয়ে দেখছি, দঙ্গল দঙ্গল লোককে ভোটদানে বাধা দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই সমস্ত বুথে ৯০%, ৯৫%, কখনও ১০০%-ই ভোট পড়েছে! এটাই তো মেকানিজম অব রিগিং!”

একই ভাবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “এ বারের ভোট যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি, প্রথম থেকেই সেই অভিযোগ করা হচ্ছিল। শুভেন্দুকে ওঁর দলের কেউ কেউ অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ রাজনীতিক। তাঁর কথায় বোঝা যাচ্ছে, ভোট নিয়ে অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়।”

বিজেপি-র সুরও এক। রাহুল সিংহ, তথাগত রায়দের বক্তব্য, তাঁরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, সন্ত্রাস এবং ভোট-লুঠ না হলে রাজ্যে বিজেপি-র ভোটের হার আরও বাড়ত। আরও বেশি আসনও তারা পেত। শাসক দলের সাংসদের কথায় সেই বক্তব্যই মান্যতা পেয়েছে বলে তাঁদের দাবি। বিরোধীদের সকলেরই বক্তব্য, তৃণমূল শুধু রিগিং করে জিতেছে, এমন কথা কেউ বলছে না। কিন্তু যে তথ্য সামনে এসেছে, সেটা স্বাভাবিক নির্বাচনের ফলও নয়। সুষ্ঠু ভোট হলে শাসক দলের জয়ের ব্যবধান এত হতো না, কিছু জায়গায় ফলাফল উল্টেও যেতে পারত।

একে তো শুভেন্দুকে যুব সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় তৃণমূলের অন্দরে প্রবল প্রতিক্রিয়া ছিলই। তার মধ্যে তৃণমূল নেতৃত্বের অস্বস্তি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে শুভেন্দুর শনিবারের মন্তব্য। দলীয় প্রার্থীদের জয়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবসরেই শুভেন্দু আরও বলেন, “পারিবারিক পরিচয়ে আমি বিধায়ক, সাংসদ হইনি!” যে মন্তব্যকে এ দিন সমর্থন করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।

এই মন্তব্যে দলের একাংশ মনে করছে, তমলুকের সাংসদের ইঙ্গিত আসলে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো এবং ডায়মন্ড হারবারের নবনির্বাচিত সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। স্বয়ং দলনেত্রীর পরিচয়ই দলে অভিষেকের উত্থানের নেপথ্যে কাজ করেছে বলে তৃণমূলের একাংশ মনে করে। অভিষেককে নেতৃত্বে বসিয়ে ‘যুবা’ নামে আলাদা সংগঠন গড়ে দিয়ে তৃণমূল নেত্রী তিন বছর আগেই যুব সভাপতি শুভেন্দুকে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। এ বার ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের কিছু অংশে ব্যাপক ভোট-লুঠের অভিযোগও রয়েছে। পাশাপাশি, মুকুল-পুত্র এবং যুব তৃণমূলের সদ্য মনোনীত কার্যকরী সভাপতি শুভ্রাংশু রায়ও শুভেন্দুর বক্তব্যের নিশানা বলে দলের ওই অংশের ব্যাখ্যা।

শুভেন্দুর মন্তব্য নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে অবশ্য রাজি হননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর কথায়, “ও (শুভেন্দু) কী বলেছে, জানি না। এ নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই।’’ তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে এ দিনই মুকুলবাবু এবং দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলন ছিল। সেখানে শুভেন্দু নিয়ে প্রশ্ন শুরু করার মুখেই তাঁরা সম্মেলন শেষ করে বেরিয়ে যান!

তবে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি। যিনি অধিকারী-শিবিরের বিরোধী বলেই পরিচিত। মমতা তাঁকে এ বার পূর্ব মেদিনীপুরের কার্যকরী সভাপতি করেছেন। অখিলবাবুর মন্তব্য, “তৃণমূল ছাড়া শুভেন্দুর কোনও জনপ্রিয়তা নেই! এক বার ও দল ছেড়ে গেলেই সেটা বুঝতে পারবে! জনপ্রিয়তা সবই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।” দলীয় প্রার্থীদের জয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে শুভেন্দু ঠিক করেননি বলেও মন্তব্য করেছেন অখিল।

তবে দলের অন্দরে অনেকেই কিন্তু শুভেন্দুবাবুর অপসারণে ক্ষুব্ধ। দলের এক শীর্ষ নেতা যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, “শুভেন্দুকে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতির পদে ২০১৬ পর্যন্ত রাখলে কী ক্ষতি ছিল?” নাম না করে ওই নেতার অভিযোগ, পরিবর্তনের নাম করে নিজের অনুগামী সৌমিত্র বা নিজের ছেলেকে পদ পাইয়ে দিয়েছেন মুকুল! দলীয় নেতৃত্বের একাংশ এমনও আশঙ্কা করছেন, শুভেন্দুকে সরানোর মধ্যে দিয়ে দলে বিভাজন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে এবং তা থেকে ভবিষ্যতে দলের বড় রকমের ক্ষতি হতে পারে।

শুভেন্দুর পক্ষে স্বস্তির খবর, তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের ধাত্রীভূমি (এবং তাঁর দলনেত্রীর রাজ্যে ক্ষমতায় আরোহণের সোপান) নন্দীগ্রাম এই সময়ে তাঁর পাশেই আছে। এ দিন ভোর থেকে নন্দীগ্রামের ভুতার মোড়ের কাছে প্রায় ৪০ জন দলীয় কর্মী-সমর্থক তৃণমূলের পতাকা নিয়ে সড়ক অবরোধ শুরু করেন। প্রায় চার ঘণ্টা পরে সকাল ১০টা নাগাদ অবরোধ ওঠে। নন্দীগ্রাম-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আবু তাহের দাবি করেন, “ওই এলাকার দলীয় সমর্থকরা আমাদের না জানিয়েই এই অবরোধ করেছে।” তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার দাবি, অবরোধের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যাত্রীদের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরে ওই ঘটনা ঘটেছে!

শুভেন্দু নিজে এ দিন অবশ্য আর কোনও তোপ দাগেননি। মেদিনীপুর শহরে এ দিন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বরং সূক্ষ্ম ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, নন্দীগ্রামের আন্দোলন এবং পরবর্তী কালে জঙ্গলমহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাঁর ভূমিকার কথা। রাজ্যে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ধন্যবাদ প্রাপ্য, সে কথাও বলেছেন। সেই সঙ্গেই তাঁর কণ্ঠে ঈষৎ অভিমান ধরা পড়েছে, যখন বলেছেন “যে কোনও সমস্যা হলে আমার হস্তক্ষেপ চাইবেন। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব। সব কাজ হয়তো করতে পারব না। আমি ক্ষুদ্র ক্ষমতার অধিকারী!”

subhendu adhikary rigging tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy