সকলে এক মঞ্চে এসে নিজের রাজ্যকে তুলে ধরুন। যিনি শিল্পপতিদের মন জয় করতে পারবেন, তিনিই নিজ রাজ্যে লগ্নি নিয়ে যাবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে এমনটাই চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন পটেল।
আগামী জানুয়ারিতে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ শিল্প সম্মেলন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আনন্দীবেন আহ্বান জানিয়েছেন, মমতা গাঁধীনগরে আসুন। দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের সামনে নিজের রাজ্যকে তুলে ধরুন। উল্টো দিকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপতিদেরও গুজরাতে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন আনন্দীবেন। কলকাতার শিল্পপতিদের সামনে গুজরাতকে তুলে ধরতে দুর্গাপুজোর পরেই কলকাতায় যাচ্ছেন গুজরাতের মন্ত্রী নিতিন পটেল।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৩ সালে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর সূচনা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রতি দু’বছর অন্তর এই শিল্প সম্মেলনের উদ্দেশ্যে স্থির হয়েছিল, দেশের শিল্পপতিদের সামনে গুজরাতকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরা। সেই সম্মেলন এ বার সাতে পা দিচ্ছে। গত দু’বারই মোদী দেশের পাশাপাশি বিদেশের শিল্পপতিদেরও আহ্বান জানিয়েছেন ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ। নিজের রাজ্যকে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-কে জাতীয় শিল্প সম্মেলন হিসেবেই দেখতে চাইছেন আয়োজন কমিটির প্রধান, শিল্পমন্ত্রী সৌরভ পটেল। শুধু তা-ই নয়, এই শিল্প সম্মেলনকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চাইছে গুজরাত সরকার। ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকায় থাকায় ১৫০টি বহুজাতিক সংস্থার সিইও এ বার গুজরাতে আসবেন। যাদের নিয়ে বসবে ‘গ্লোবাল সিইও মিট’। যা ভারতের ইতিহাসে প্রথম। বেশ কয়েক জন রাষ্ট্রপ্রধানও এই সম্মেলনে হাজির হবেন বলে গুজরাত সরকারের আশা। শুধু গুজরাত নয়, গোটা ভারতেই লগ্নি টানার জন্য এই মঞ্চকে ব্যবহার করতে চান মোদী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন।
প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কি এই চ্যালেঞ্জ নেবেন? সিঙ্গুর নিয়ে মমতার আন্দোলনের জেরেই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে রতন টাটা গুজরাতের সানন্দে গিয়ে ন্যানো-র কারখানা তৈরি করেছেন। গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদীই তার জন্য জমি ও অন্য সব রকম বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি এখন বাংলার শিল্পপতিদের গুজরাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন। আবার মমতাকেও তাঁর রাজ্যে গিয়ে লগ্নি টানার সুযোগ করে দিতে চাইছেন।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুজরাতের শিল্প সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে রাজনৈতিক কারণ বা অতীত তিক্ততার কোনও উল্লেখ করছেন না রাজ্য সরকারের কেউ। পুর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, “জানুয়ারি মাসের ওই একই সময়ে কলকাতায় ‘বিশ্ব বাংলা’ শিল্প সম্মেলন বসবে। দু’টো সম্মেলন প্রায় একই সময়ে হচ্ছে।” শেষ পর্যন্ত এই কারণ দেখিয়েই মমতা ‘চনমনে গুজরাত’-এর ডাক এড়িয়ে যাবেন কি না, সময়ই তা বলবে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জি সি মুর্মু বলছেন, “আমরা সব রাজ্যকেই আহ্বান জানাচ্ছি, এই সম্মেলনে যোগ দিন। দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের সামনে নিজের রাজ্যকে তুলে ধরুন। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতে এসে কোনও শিল্পপতি যদি তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র বা পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির সিদ্ধান্ত নেন, তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। আখেরে দেশের অর্থনীতিরই লাভ।’’
একই বক্তব্য বণিকসভাগুলিরও। তারাও মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপতিদের গুজরাতে লগ্নির জন্য আহ্বান জানানোর মধ্যে দোষের কিছু নেই। বণিকসভার কর্তাদের বক্তব্য, এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তো দিল্লি ও মুম্বইয়ে গিয়ে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলায় লগ্নি করার জন্য। এখন আবার রাজারহাটের ফিনান্সিয়াল হাবে বিনিয়োগের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন রাজ্যে দরবার করছে। প্রতিযোগিতায় সকলেরই ভাল হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ যে এখন আর গুজরাতে বিনিয়োগ টানার জন্য আয়োজন করা হচ্ছে না, একে জাতীয় স্তরের শিল্প সম্মেলন হিসেবে ভাবা হচ্ছে, তা বোঝাতেই এ বার দেশের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি শহরে প্রাক্-সম্মেলন বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাত সরকার। দিল্লির বৈঠকে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী আন্দদীবেন নিজেই। এর পর একে একে মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু সব জায়গাতেই বৈঠক হবে। কলকাতায় বৈঠক হবে ১৪ অক্টোবর। সেখানে মন্ত্রী নিতিন পটেলের পাশাপাশি থাকবেন রাজ্য সরকারের আমলারাও।
রাজ্যের ‘ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এক্সটেনশন ব্যুরো’-র এমডি পি স্বরূপ বলেন, “এর উদ্দেশ্য দু’টি। প্রথমত, চনমনে গুজরাত সম্পর্কে সকলকে জানানো। দ্বিতীয়ত, ওই রাজ্যের শিল্পপতিরা গুজরাতে বিনিয়োগ করতে চাইলে রাজ্যের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। যে সব শিল্পপতি ইতিমধ্যেই গুজরাতে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরাও নিজেদের সমস্যার কথা মন্ত্রী-আমলাদের জানাতে পারেন।” শিল্প দফতরের কর্তাদের ব্যাখ্যা, অন্য রাজ্যে কারখানা গুটিয়ে সবাইকে গুজরাতে চলে আসতে বলা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপতিরা ভাইব্র্যান্ট গুজরাতে এলে একই সঙ্গে বহু দেশি-বিদেশি শিল্পপতিদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। হতেই পারে, সেখান থেকেই যৌথ উদ্যোগে শিল্প বা ব্যবসার দরজা খুলে গেল। তা ছাড়া, গুজরাত যেমন পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সেখানকার শিল্পপতিদের আহ্বান জানাচ্ছে, তেমন পশ্চিমবঙ্গও গুজরাতি শিল্পপতিদের সেখানে লগ্নির আমন্ত্রণ জানাতে পারে।
গুজরাতের শিল্পমন্ত্রী সৌরভ পটেল বলেন, “আমরা ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের মঞ্চটা সব রাজ্যের জন্য খুলে দিতে চাইছি। ২০০৩ সালে যখন ভাইব্র্যান্ট গুজরাত শুরু হল, তখন এর উদ্দেশ্য ছিল গুজরাতকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার পরে অন্য রাজ্যের তুলনায় গুজরাতকেই লগ্নির জন্য সেরা রাজ্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এ বার আমরা সব রাজ্যকেই সুযোগ করে দিতে চাই। তাঁরা এসে নিজের রাজ্যের কথা বলুন।” জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন থেকে শুরু করে কানাডা, সিঙ্গাপুরের মতো ৭টি দেশ এ বারের শিল্প সম্মেলন আয়োজনে গুজরাতের ‘পার্টনার কান্ট্রি’। ২০১৩ সালে দেশের ১০টি রাজ্য সামিল হয়েছিল। এ বার ২৯টি রাজ্যকেই ডাকা হচ্ছে। বেশ কিছু রাজ্য ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা গুজরাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘পার্টনার স্টেট’ হতে চায়। ‘পার্টনার স্টেট’ হলে শিল্প সম্মেলনে ওই রাজ্যের তরফে আলাদা করে বক্তব্য রাখার সুযোগ মিলবে। গাঁধীনগরের মহাত্মা মন্দির সম্মেলন কক্ষে ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি শিল্প সম্মেলন। তার আগে ৮ জানুয়ারি থেকেই শুরু হয়ে যাবে ‘গ্লোবাল ট্রেড শো’। মোট ১ লক্ষ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে প্রদর্শনীস্থল তৈরি হচ্ছে। আকারে যা দিল্লির প্রগতি ময়দানকেও ছাপিয়ে যাবে। শরিক রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যকে ‘শো-কেস’ করার জন্য বড় মাপের প্যাভিলিয়ন পাবে।
শিল্পের খরা কাটাতে পশ্চিমবঙ্গ কি কাজে লাগাবে সেই সুযোগ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy