বিমানবন্দরের সামনে বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের জন্য ভিড়। পাহারায় এক তালিবান যোদ্ধা। রবিবার কাবুলে। রয়টার্স
তালিবান কাবুল দখলের পরেই পালাবদলের ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। ঠিক এই সময়েই দেশের অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো সবচেয়ে বড় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক টোলো নিউজ়কেও সিদ্ধান্ত নিতে হত, ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালু রাখা হবে, না কি বন্ধ করে দেওয়া হবে সম্প্রচার। টোলো কর্তৃপক্ষ অবশ্য সম্প্রচার জারি রাখেন। কিন্তু সামনে যে কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে, বুঝতে দেরি হয়নি কারও। এক দিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দোলাচল, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এবং নামী সাংবাদিকদের দেশ ছাড়ার হিড়িক, অন্য দিকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিয়ো স্টেশন।
টোলো নিউজ়ের ডিরেক্টর লোতফুল্লা নজফিজ়াদা বলেছেন, ‘‘কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। কাজ চলবে না কি বন্ধ রাখা হবে, বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল চালু রাখতে সেই সব নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দম ফেলার সুযোগ মিলছে না।’’ তিনি জানিয়েছেন, সংবাদ পরিবেশনের বাধ্যবাধকতা থেকে এখনও চ্যানেল বন্ধ রাখা হয়নি।
১৯৯৬-’০১ জমানায় অধিকাংশ টিভি চ্যানেল এবং বিনোদন চ্যানেল বন্ধ রাখার নিদান জারি করেছিল তালিবান। গত ২০ বছরেও সাংবাদিক হত্যা ও হুমকির ধারা বজায় রেখেছিল তালিবান। তবে এ বারে মসনদ দখলের পরে অবশ্য নিজেদের অন্য রূপ প্রতিষ্ঠা করতেই মরিয়া হিবাতুল্লা আখুন্দজ়াদারা। ইতিমধ্যেই তালিবান নেতৃত্ব জানিয়েছেন, স্বাভাবিক ভাবেই কাজ করতে পারবে সংবাদমাধ্যম। তাদের উপরে কোনও বলপ্রয়োগ করা হবে না। এমনকি ভাবমূর্তি বদলাতে বেহেশতা আরঘান্ড নামে এক মহিলা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন এক তালিবান নেতা। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ মানুষই। টোলো গ্রুপের সিইও সাদ মহসেনির কথায়, ‘‘আমরা প্রত্যেকেই বিনিদ্র রজনী যাপন করছি।’’
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, শতাধিক বেসরকারি চ্যানেল আপাতত পরিষেবা বন্ধ রেখেছে। সংবাদ সংস্থা দ্য পাজওক জানিয়েছে, অধিকাংশ চ্যানেল বন্ধের কারণ আর্থিক সঙ্কট। এ ছাড়া বহু মহিলাকে সংবাদমাধ্যম ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানাচ্ছে, ২০২০ সালে যেখানে কাবুলে অন্তত ৭০০ মহিলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পরে সেই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৭৬। তালিবান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার বার্তা দিলেও হেনস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। কাবুল দখলের পরে বহু সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা। জার্মান সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিকের পরিজনকে হত্যাও করা হয়েছে। এমনকি লাইভ টেলিভিশন শোয়ে সংবাদ পাঠককে ঘিরে রয়েছে বন্দুকধারীরা, সেই দৃশ্যও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার্থে তালিবান নেতৃত্ব কতটা আন্তরিক। এমনই পরিস্থিতিতে দলে দলে দেশ ছেড়েছেন আফগান সাংবাদিকরা। সেই তালিকায় শামিল বেহেশতা আরঘান্ডও। এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, প্রাণভয়েই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে একটি সংবাদ সংস্থা আগামী দিনে বিদেশের মাটি থেকে সংবাদ পরিবেশনের পরিকল্পনা িনয়েছে। টোলো নিউজ়ের সিইও সাদ
মহসেনি জানান, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বা সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। এরই প্রতিফলন বেহেশতাদের দেশ ছাড়ার ঘটনা। বহু নামি সাংবাদিক দেশ ছাড়ায় সংবাদের গুণমান বজায় রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ কর্তৃপক্ষের। মহসেনির কথায়, ‘‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, একটা প্রজন্ম, যাঁরা সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা হয় দেশ নয়তো পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। আগামী দু’দশকে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়।’’
২০০১ সালে তালিবান জমানা শেষ হতেই বহু টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি ১৬০টিরও বেশি রেডিয়ো স্টেশন আফগানিস্তানে তৈরি হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। এই সংস্থাগুলির হাত ধরে আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক বদলও ঘটছিল। আমেরিকান আইডলের ধাঁচে গানের প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সোপ অপেরা, এমনকি দেশে নির্বাচনের আগে ‘প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেট’-এরও আয়োজন করা হয়। বহু মহিলা শামিল হয়েছিলেন এই কর্মযজ্ঞে। কিন্তু তালিবানের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে ফিরে এসেছে দমবন্ধ পরিবেশ ও আতঙ্কও। টোলো গ্রুপের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনোদন সংক্রান্ত বহু অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy