সমুদ্রতটে মরে পড়ে থাকা সেই শরণার্থী বাচ্চা আলান।
শেকড়-ছেঁড়া গাছ নাকি বাঁচে না। টিমা কুর্দি তবু আশা রাখেন, মানুষের বেলায় অন্তত মিথ্যে হবে প্রবাদটা।
পদবিতে দুনিয়াজো়ড়া ‘খ্যাতি’ বয়ে বেড়াচ্ছেন টিমা, বুকে বইছেন আত্মদহন। তাঁর গলার সরু চেন থেকে ঝুলে থাকে একটা লকেট। ওটাই যন্ত্রণা। লকেট থেকে তাকিয়ে হাসছে টিমার দুই খুদে ভাইপো, গালিব আর আলান। ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর রবারের ডিঙিতে করে ভূমধ্যসাগর পেরোতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল ওরা। পরের দিন বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা নিস্পন্দ আলান দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছিল ‘সমুদ্রতটে মরে পড়ে থাকা শরণার্থী বাচ্চা’ নামে। ‘দ্য বয় অন দ্য বিচ।’
হৃদয় মুচড়ে টিমা যে বইটা লিখেছেন, তার নামও ওই এক— ‘দ্য বয় অন দ্য বিচ’। এ এক পরিবারের চুরমার হয়ে যাওয়ার গল্প, একটা ছেঁড়া ছবি আঁকড়ে অনিশ্চিতের পথে ভাসতে থাকার গল্প। যে গল্পের চোরাস্রোত বারবার বলে যায়, আলান কুর্দি মানে শুধুই ‘সমুদ্রতটে পড়ে থাকা ওই বাচ্চাটা’ নয়। এমন কত আলানের খবর কে রাখে!
আলানের মৃত্যুর পরের ক’দিন খুব হইচই আর আবেগের বন্যা বয়েছিল দুনিয়ায়। সেই পরিস্থিতি এখন বদলে গিয়েছে। সিরীয় শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অনেক দেশের জনতা আর রাজনৈতিক দল এখন শরণার্থীদের জায়গা দিতে ভুরু কুঁচকোয়। তবু টিমা আশা রাখেন, সিরিয়ার সব ঘরছাড়া মানুষ এক দিন ঠিকানা পাবেন। তাঁর বই তাই প্রচ্ছন্নে ভীষণ রকম রাজনৈতিক বিবৃতি। আবার নিজেকে চাবুক-মারা যন্ত্রণার দলিল। বৌ-বাচ্চা নিয়ে দালালদের ডিঙিতে ওঠার জন্য আলানের বাবা আবদুল্লাকে ৫ হাজার ডলার তো টিমাই পাঠিয়েছিলেন! পিসির দেওয়া জামা-প্যান্ট-জুতো পরেই তো মারা গিয়েছিল আলান।
টিমার বইয়ে যেমন রয়েছে ‘সত্যিকারের’ আলান, তেমনই আরও একটা উপন্যাসে ছায়া ফেলে গিয়েছে সে। খালেদ হোসেইনি-র ‘সি প্রেয়ার’। আলানকে দেখেই বইটা লিখেছেন ‘দ্য কাইট রানার’-এর লেখক। কিন্তু বলেছেন, ‘‘আলানের পরিবারের মতো যুদ্ধে ঘরছাড়া আরও অনেক পরিবারকে এ আমার কুর্নিশ।’’
‘সি প্রেয়ার’ এক বাবা আর ছেলের গল্প। যুদ্ধ-ধ্বস্ত সিরিয়ার হোমস থেকে পালাচ্ছে তারা। সমুদ্রতীরে চলছে অপেক্ষা। ভোর হলেই আসবে একটা নৌকা। তাতে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে পারলেই বোমা-গুলির বারুদগন্ধ ছাড়িয়ে চলে যাওয়া যাবে অনেক দূরে।
কোলে ঘুমন্ত ছেলের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বাবা। মনে পড়ে সেই দিনগুলো, যখন গরমকালের ঝলমলে দিনগুলোয় হাওয়ায় দুলত বাড়ির জলপাই গাছটা, ঠাকুমা খুটখাট করত রান্নাঘরে, বাইরে বেরোলেই গমগমে রাস্তা। আকাশ থেকে রাশি রাশি বোমা নেমে আসেনি তখনও। পুরোটাই একটা চিঠি যেন। বাবা বলে চলে — ‘‘মারওয়ান, সোনা আমার। চাঁদের আলোয় তোর ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে আছি। তোর বোজা চোখের পাতাগুলো মনে হচ্ছে যেন তুলি দিয়ে আঁকা। আমার হাত ধর। আমাদের খারাপ কিছু হতেই পারে না।’’
আগামী ৩০ তারিখ প্রকাশিত হবে হোসেইনির বই। দামের একটা অংশ যাবে শরণার্থীদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের তহবিলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy