Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
আতঙ্কের দেশে আনন্দবাজার

ছন্দে ফিরছে শহর, আশায় বেস ক্যাম্পও

চার দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও অঙ্ক মেলাতে হিমসিম খাচ্ছেন নিমা শেরিং শেরপা। যে গ্রামে কয়েক ঘণ্টা আগেই রাত কাটিয়েছিলেন, সেই গ্রামই এ ভাবে স্রেফ উধাও হয়ে যেতে পারে —এই হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছেন না নিমা। আট বছর হয়ে গেল পাহাড়ে শেরপার কাজ করছেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুকে এত কাছ থেকে কখনও দেখেননি। গোটা পাহাড়ের চুড়ো যে গড়িয়ে নেমে আসতে পারে, তা ভাবতেও পারেননি। কয়েকশো মিটার দূর দিয়ে ধসটি নেমে গেলেও আহত হয়েছেন নিমা নিজে ও তাঁর সঙ্গী ফরাসি দম্পতি প্যাট্রিক ও রাবেয়া। ওই তিন জন প্রাণে বেঁচে গেলেও, নেপালের মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে লাংটাং গ্রামটা।

আহত ফরাসি অভিযাত্রীকে চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশে। —নিজস্ব চিত্র।

আহত ফরাসি অভিযাত্রীকে চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশে। —নিজস্ব চিত্র।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
কাঠমান্ডু শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩৪
Share: Save:

চার দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও অঙ্ক মেলাতে হিমসিম খাচ্ছেন নিমা শেরিং শেরপা। যে গ্রামে কয়েক ঘণ্টা আগেই রাত কাটিয়েছিলেন, সেই গ্রামই এ ভাবে স্রেফ উধাও হয়ে যেতে পারে —এই হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছেন না নিমা।

আট বছর হয়ে গেল পাহাড়ে শেরপার কাজ করছেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুকে এত কাছ থেকে কখনও দেখেননি। গোটা পাহাড়ের চুড়ো যে গড়িয়ে নেমে আসতে পারে, তা ভাবতেও পারেননি। কয়েকশো মিটার দূর দিয়ে ধসটি নেমে গেলেও আহত হয়েছেন নিমা নিজে ও তাঁর সঙ্গী ফরাসি দম্পতি প্যাট্রিক ও রাবেয়া। ওই তিন জন প্রাণে বেঁচে গেলেও, নেপালের মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে লাংটাং গ্রামটা।

এভারেস্ট যাঁদের টানে না, তাঁদের অনেকেই চলে আসেন লাংটাং শৃঙ্গ আরোহণে। যেমনটা এসেছিলেন প্যাট্রিক ও রাবেয়া। ছবির মতো সুন্দর লাংটাং গ্রামে রাত কাটিয়ে নিমার সঙ্গে লাংটাং শৃঙ্গের পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন দু’জনে। বেলা বারোটা নাগাদ আসা ভূমিকম্পের ধাক্কায় বেশ কয়েক ফুট ছিটকে যান তিন জনই। হুঁশ ফিরতেই দেখেন পাহাড়ের মাথা ভেঙে নেমে আসছে বরফ-পাথরের চাঁই। নিমার কথায়, ‘‘সাদা ধোঁয়ার আস্তরণটা এগিয়ে আসছে দেখেই ভয়ে চোখ বুজে ফেলি। বুঝে যাই, বাঁচার আর কোনও আশা নেই। কিন্তু হঠাৎই ধসটি পাহাড়ের অন্য ঢালে গড়িয়ে যায়। পরে জানতে পারি ওই ধসের গন্তব্য ছিল লাংটাং গ্রাম।’’

পাশ দিয়ে ধস নামার সময়ে যে পাথর-নুড়ি-বরফ ছিটকে এসেছে তাতে কম-বেশি আহত তিন জনই। তবে প্যাট্রিকের চোট গুরুতর বলেই জানালেন কাঠমান্ডুর সেবক ট্র্যাভেল মেডিসিন সেন্টারের অধিকর্তা প্রতিভা পাণ্ডে। তাঁর কথায়, ‘‘এভারেস্টের মতোই লাংটাং অভিযাত্রীদের আঘাত গুরুতর। অধিকাংশেরই কোমরের নীচে চোট লেগেছে।’’ হেলিকপ্টারে নীচে নামার সময় এক বার লাংটাং গ্রামের দিকে তাকিয়েছিলেন নিমা। বললেন, ‘‘ওখানে আর কিছুই নেই। বরফ-কাদার তালে চাপা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে আস্ত গ্রামটা।’’ কাঠমান্ডু এসে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নিমা জেনেছে, ওই দিন গ্রামের প্রায় দু’শো বাসিন্দার মধ্যে নব্বই শতাংশ মারা গিয়েছেন।

তবে মৃত্যুর সঙ্গে দেখা করে এসেও ফের পাহাড়ে যেতে চান নিমা। তাঁর কথায়, ‘‘এটা তো আমাদের রুটি-রুজি। ভয় পেলে খাব কী!’’ ঠিক একই যুক্তিতে এ বারের এভারেস্ট অভিযান বাতিলের বিরুদ্ধে নেপাল মাউন্টিয়ারিং অ্যসোসিয়েশন (এনএমএ)। শনিবারের ভূমিকম্পের পরে নেমে আসা তুষারধসে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে ২২ জন মারা যান। যাঁদের মধ্যে ছিলেন শেরপা ও আইসফল ডক্টররা।

কারা এই আইসফল ডক্টর? বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত শেরপাদের এক অংশ, যাঁরা বড় অভিযানের পুরোভাগে থাকেন এবং আরোহণের জন্য রুট ওপেন করেন। সাধারণ শেরপারা অভিযাত্রীদের আরোহণ করাতে বা জিনিসপত্র বইতে সাহায্য করলেও, তুষার-রাজ্যে মানুষের চলার পথ তৈরি করার কাজটা করেন আইসফল ডক্টররাই। বিশেষ প্রশিক্ষণ না থাকলে এই কাজটা যে কোনও শেরপার পক্ষে করা সম্ভব নয়। অভিজ্ঞ ওই শেরপারাই অভিযান শুরুর আগে আরোহণের রাস্তা তৈরি করেন।

গত বছরেও বিপর্যয়ের পরে বাতিল হয়ে যায় এভারেস্ট অভিযান। এ বারও সেই দাবিই উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু গত দু’দিন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় নতুন চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে এনএমএ। সংস্থার প্রেসিডেন্ট আং শেরিং শেরপা বললেন, ‘‘আজ সকালেই একাধিক পর্বতারোহণ সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। ইতিবাচক কোনও সিদ্ধান্ত দিন দুয়েকের মধ্যেই হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’’

এই আশা নিয়েই এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে এখনও নামেননি তিন বাঙালি অভিযাত্রী দেবরাজ দত্ত, প্রদীপ সাহু ও চেতনা সাহু। এ দিনই বেস ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন জ্যোৎস্না শেঠ। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে বেস ক্যাম্পে আছেন আরও দেড়শো অভিযাত্রী। এ দিন বিকেলে বেস ক্যাম্পের নীচে নামচে বাজার পর্যন্ত নেমেছেন বাকি অভিযাত্রী সুনীতা, লিপিকা, গৌতম, রমেশ, সৌরভসিঞ্চন, সত্যরূপ, মলয়, রুদ্রপ্রসাদ। তবে এখনই কাঠমান্ডু ফেরার কথা ভাবছেন না তাঁরাও।

কসবার সৌরভসিঞ্চন বললেন, ‘‘এখনও পিছন দিকেই তাকিয়ে আছি। যদি কোনও সিদ্ধান্ত হয়...।’’ হাওড়ার মলয় মুখোপাধ্যায় জানালেন, নামচে বাজার এলাকায় সাগরমাতা পলিউশন কন্ট্রোল কমিটি (এসপিসিসি)-র বৈঠক হবে বৃহস্পতিবার। সেখানেই সরকারি সিদ্ধান্ত জানা যেতে পারে। অভিযান বাতিল না হলে ফের আরোহণ শুরু করবেন তাঁরা। বেস ক্যাম্প থেকে দেবরাজ দত্ত বললেন, ‘‘খবর পেয়েছি অসমের যে অভিযাত্রী দলটি বেস ক্যাম্পে আছে, তাদের ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ কয়েক জন আইসফল ডক্টর নিয়ে বেস ক্যাম্পে আসছেন। নতুন করে রুট খোলা যাবে কি না, সে ব্যাপারে বৈঠক করবেন তাঁরা।’’

এনএমএ-র ব্যাখ্যা, তুষারধসে মূলত বেস ক্যাম্পের সামনের অংশের ক্ষতি হয়েছে। পিছনের অংশটা ঠিকই রয়েছে। বেস ক্যাম্পের উপরের দু’টি শিবির এখনও অক্ষত। আং শেরপার কথায়, ‘‘এ বছর সামিট ইউন্ডো বা শৃঙ্গে ওঠার আদর্শ সময় ১৫ মে-র পর। তাই হাতে সময় রয়েছে।’’

বেস ক্যাম্পের যে এমন অবস্থা হতে পারে, ভাবতে পারছেন না বাংলার তিন পর্বতারোহী রাজীব ভট্টাচার্য, দেবদাস নন্দী ও বিপ্লব বৈদ্য। বাঙালি অভিযাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে আনতে কাঠমান্ডু এসেছেন তাঁরা। দেবদাস নন্দী বললেন, ‘‘টিভিতে বেস ক্যাম্পের যা ছবি দেখেছি, তাতে আমরাও অবাক।’’ সঙ্গী বিপ্লব বৈদ্যের বক্তব্য, ‘‘তুষারধসে পড়লে কী করতে হবে, তা আমাদের শেখানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে ভাবে ধস নেমেছে, তাতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই।’’

চার দিনের মাথায় আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরছে রাজধানী কাঠমান্ডু। বিদ্যুৎ পরিষেবা অনেকটাই স্বাভাবিক। দোকান-পাটও আজ বেশি খুলেছে। মাঠের আশ্রয় ছেড়ে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন শহরবাসী। কিন্তু ত্রাণ-বিলির সুষ্ঠু তদারকিতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপালের অভিযোগ, ‘‘সরকার মাঠে নেমে ত্রাণ দেওয়ার বদলে বৈঠক করছে বেশি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE