জুলাই সনদ, গণভোট, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ যখন আলোচনায় ব্যস্ত, তখন গোপনে পট পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে জোরকদমে। সূত্রের দাবি, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস নাকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকেও সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের আইনজীবী মহলের একাংশের মতে, আইনসভাকে এড়িয়ে ইউনূস যদি রাষ্ট্রপতি হন, তা হবে চরম বেআইনি কাজ।
২০২৪ সালের অগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দেশের দায়িত্বভার নিয়েছেন ইউনূস। বাংলাদেশে নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই ইউনূসের তৎপরতা ততই ‘বাড়ছে’। একটি সূত্রের দাবি, এখন অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধানের পাশাপাশি, দেশের রাষ্ট্রপতিও হতে চাইছেন তিনি। প্রশাসনের এক আধিকারিক ওই সূত্রকে জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে দেশত্যাগে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সাহাবুদ্দিন দেশত্যাগ করলে, ইউনূস রাষ্ট্রপতি হবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ইউনূসের পরিকল্পনা হল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং ইসলামপন্থী দলগুলিকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা, আর তিনি নিজে রাষ্ট্রপতি হবেন।
আর একটি সূত্রের দাবি, সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরাতে গত ১৫ মাসে কম চেষ্টা করেননি ইউনূস। কিন্তু এ বার তিনি প্রায় মরিয়া এবং সাহাবুদ্দিনকে নাকি তিনি প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছেন। আগামী ৬ নভেম্বর পাবনায় তাঁর পৈতৃক ভিটেয় যাবেন রাষ্ট্রপতি। সেখানে তিনিতাঁর মা-বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানাবেন। ঢাকার প্রশাসনিক মহলে গুঞ্জন, রাষ্ট্রপতি হয়তো দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ও তার আগে বোধ হয় মা-বাবারসমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূসের হাতেই দেশের চালিকাশক্তি। তা সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রপতি হতে এত তৎপর কেন? ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলির যুক্তি, রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি নিজের হাতে নিতে চান ইউনূস। তা হলে জামায়াতে ইসলামী যে কাজগুলি জন্য চাপ বাড়াচ্ছে তা তিনি করে ফেলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে আরও কিছুটা সময় পাবেন। কিন্তু এক কূটনীতিকের কথায়, ‘‘ইউনূস চান সাংবিধানিক রক্ষাকবচ। অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলা এবং সাজাগুলি সব বাতিল হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে কোনও নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা এসেছে, সেই মামলাগুলি আবার চালু করবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়! কিন্তু ইউনূস রাষ্ট্রপতি হলে তিনি সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পাবেন। তাই ওই পদের জন্য তিনি এতটা মরিয়া।’’
এ ক্ষেত্রে আইনজীবী মহলের যুক্তি, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পার্লামেন্ট ছাড়া সম্ভব নয়। এমপি-রা ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন। কিন্তু বর্তমানে পার্লামেন্ট নেই। তাই ইউনূসের নির্বাচিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তা সত্ত্বেও তিনি যদি রাষ্ট্রপতি হন, তা হলে তা হবে আইনবিরুদ্ধ কাজ। এক প্রথম সারির আইনজীবীর বক্তব্য, ‘‘বাংলাদেশে পার্লামেন্ট অধিবেশন ছাড়া কোনও রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করা যায় না। সুতরাং বর্তমানে ইউনূসের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা ঠিক ততটাই বেআইনি, যতটা বেআইনি হল তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বহাল থাকা, যার কোনও আইনি ভিত্তি নেই।’’
দেশের প্রথিতযশা আর এক আইনজীবীর মতে, ইউনূস এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যার আইনগত কোনও ভিত্তি নেই। এই সরকারের দ্বারা গৃহীত সব সিদ্ধান্তই বেআইনি। তাঁর কথায়, “এখন যদি ইউনূস নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন, তা হবে চূড়ান্ত বেআইনি। আর যদি তিনি বেআইনি ভাবে রাষ্ট্রপতিহন, তবুও তিনি বিচারের হাত থেকেরক্ষা পাবেন না। বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতির পদ বেআইনিভাবে দখল করার অভিযোগে মামলার মুখে পড়তে পারেন।’’
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, রাষ্ট্রপতি দেশত্যাগ করবেন এবং ইস্তফা দেবেন আর ইউনূস তাঁর জায়গায় গিয়ে বসে পড়বেন— সমীকরণ এত সহজ নয়। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির বাতাসে এখন বড় ঘূর্ণি, সেই ঘূর্ণি কখন কোন দিকে মোড় নেবে, তা বোঝা দুষ্কর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)