E-Paper

রয়েছে সচেতনতা, তবু ‘অটিস্টিক’ বলে গালি!

হাল্কা রসিকতার চালে হলেও কোনও মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার অভাবকে ‘অটিস্টিক’ বলে দেগে দেওয়ার মধ্যে একটা প্রবল অসংবেদনশীল মনোভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু পরিতাপের কথা, কার্লসনের এই মনোভাব ব্যতিক্রমী নয়।

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪৫
An image representing Autistic Kid

‘স্পেশাল এডুকেটর’ বা ‘বিশেষ শিক্ষক’ হিসেবে অটিস্টিক ছাত্রছাত্রীদের রোজকার লড়াইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ। প্রতীকী ছবি।

ফক্স নিউজ়ের জনপ্রিয় সঞ্চালক টাকার কার্লসনের পদত্যাগ নিয়ে সরগরম আমেরিকার রাজনীতি। এই সঞ্চালককে কেন খবরের চ্যানেলটি থেকে ইস্তফা দিতে হল, তা স্পষ্ট করেনি কোনও পক্ষই। কিন্তু গুঞ্জন, ২০২০-র নির্বাচনে ভুয়ো ভোটযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, বার বার সেই দাবি করা এবং তার ফলস্বরূপ ফক্স নিউজ়ের বিরুদ্ধে ভোটযন্ত্র সংস্থাটির মামলা কার্লসনকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ বাড়িয়েছিল। তবে জানা গিয়েছে, ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কার্লসনের এই ‘অপসারণ’-এ যুগপৎ বিস্মিত ও দুঃখিত খোদ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

প্রবল ট্রামপন্থী বলে পরিচিত কার্লসনকে সরিয়ে দেওয়ায় রিপাবলিকান নেতা যে বিস্ময় প্রকাশ করবেন, তার মধ্যে বিশেষ বিস্ময়ের কিছু নেই। যেটা আশ্চর্যের ও দুঃখের তা হল, এই কার্লসন কিন্তু গত মাসে একটি অনুষ্ঠানে ট্রাম্পকে ‘অটিস্টিক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কার্লসনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই যে ট্রাম্প দাবি করছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতেন, সেই মন্তব্যের কী কোনও ভিত্তি আছে? উত্তরে কার্লসন বলেন, ‘‘ট্রাম্পের সপক্ষে একটা কথাই বলতে পারি— উনি কিঞ্চিৎ অটিস্টিক!’’

হাল্কা রসিকতার চালে হলেও কোনও মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার অভাবকে ‘অটিস্টিক’ বলে দেগে দেওয়ার মধ্যে একটা প্রবল অসংবেদনশীল মনোভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু পরিতাপের কথা, কার্লসনের এই মনোভাব ব্যতিক্রমী নয়। তাই অতি-ডানপন্থী খবরের চ্যানেলের প্রবল ডানপন্থী তারকা সঞ্চালকের এই মন্তব্যে বিশেষ সমালোচনারঝড় ওঠেনি।

কার্লসনের এই মন্তব্যের দিন কয়েক পরেই শুরু হল এপ্রিল। আমেরিকা তথা সারা বিশ্বে এই মাসটি ‘অটিজ়ম স্বীকৃতির মাস’ হিসেবে পালন করা হয়। শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে, যাতে অটিজ়ম সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতন হন. নিজেদের কিছুটা শিক্ষিত করে তোলেন এবং অটিস্টিক মানুষদেরকে সহমর্মিতার আলোয় দেখেন। তখন বলা হত ‘অটিজ়ম সচেতনতা’ মাস, কারণ তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে অটিজ়ম সম্পর্কে সচেতনতারই যথেষ্ট অভাব ছিল। এখন অবশ্য ‘সচেতনা’র জায়গা করে নিয়েছে ‘স্বীকৃতি’, অর্থাৎ অটিজ়ম আক্রান্ত মানুষের সমাজের মূলস্রোতে জায়গা করে নেওয়ার লড়াই। তবে সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে সচেতনতার পাঠও। কারণ এখনও তো অনেকেই জানেন না যে, অটিজ়ম কী? জানেন না যে, অটিজ়ম কোনও অসুস্থতা নয়, যা কোনও এক দিন চিকিৎসা করে ‘ভাল’ হয়ে যাবে। চিকিৎসার পরিভাষায় বললে এটি এক ধরনের ‘ডেভলপমেন্টাল ডিজ়অর্ডার’ যাতে মানুষের মস্তিষ্ক অন্য রকম ভাবে কাজ করে। অটিস্টিক মানুষেরা অনেক সময়ে আত্মমগ্ন হন, নিজের চারপাশের বিষয়ে সচেতন হন না, অন্য মানুষের সাথে সংযোগ করতে পারেন না বা চান না। অনেক সময়ে তাঁরা নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হন, সেই বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান খুব গভীর হয়, তাঁরা সেই বিষয়টিতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এক রকম লক্ষণ সকলের মধ্যে থাকে না। এই সমস্যাগুলো প্রতিদিনের জীবনযাপনে, বাড়িতে, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে, মানুষভেদে সেটার পরিসর অনেকখানি ।

‘স্পেশাল এডুকেটর’ বা ‘বিশেষ শিক্ষক’ হিসেবে অটিস্টিক ছাত্রছাত্রীদের রোজকার লড়াইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ। নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী স্কুলের বিশেষ ক্লাসে পড়াশোনা থেকে শুরু করেযথাসম্ভব ‘জেনারেল’ বা সাধারণ শ্রেণিতে তাদের অন্তর্গত করা— আমেরিকার স্কুলে-স্কুলে সব ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে। অটিস্টিক-সহ বিশেষ ভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীরা এ দেশের স্কুলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘সাধারণ’ ছাত্রছাত্রীরা খুব ছোট থেকে এই বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্চাদের তাদের ক্লাসরুমে দেখতে অভ্যস্তহয়ে যায়।

সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোলের সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বলছে, এ দেশে ছত্রিশ জনের মধ্যে এক জন বাচ্চার অটিজ়ম ধরা পড়ছে। গত এক দশকে অটিজ়িমের বিষয়ে চিকিৎসক ও অভিভাবকদের মধ্যে অনেক সচেতনতা বেড়েছে, ফলে দেড় বছর বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে অটিজ়মের লক্ষণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে শিশুটিকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে অবিরাম।

সচেতনতা ও স্বীকৃতির এই ছবি আমাদের ভরসা জোগায়। কিন্তু অন্য দিকে, কার্লসনের মতো এক প্রভাবশালী সাংবাদিকের অটিজ়ম সংক্রান্ত অত্যন্ত অসংবেদনশীল মন্তব্য সংশয় বাড়িয়ে দেয়, সত্যিই কি সচেতন হতে পেরেছে আমেরিকা?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Autism Autistic Child usa awareness

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy