মাত্র এক দিন আগেই ফেসবুকে ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুর রহমানের হত্যার প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তিনি। মঙ্গলবার সকালেই তার মাসুল দিতে হল মুক্তমনা ব্লগের আর এক লেখক অনন্তবিজয় দাসকে। যাঁদের নৃশংস খুনের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি, ঠিক তাঁদের মতোই প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে খুন করা হল অনন্তকে।
‘‘অভিজিৎ রায়কে যখন খুন করা হয়, অদূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল, খুনিরা নিশ্চিন্তে খুন করে চলে গেল।’’— ফেসবুকে সোমবার লেখেন অনন্ত। উঠে এসেছিল ওয়াশিকুরের প্রসঙ্গও, ‘‘ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে যখন খুন করে খুনিরা পালিয়ে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল।’’ শুধু তাই নয়, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার হুমকি দেওয়ায় সিলেটে শাসক দলের এক সাংসদের সমালোচনা করেন অনন্ত।
মঙ্গলবার সকালে থেমে গেল সদ্য তিরিশ পেরনো সেই স্বর। সিলেটে নিজের বাড়ির অদূরে খুন হতে হল এই প্রতিবাদী লেখককে। সিলেটের সুবিদবাজারের বনকলাপাড়া থেকে রিকশায় শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তখনই চার জন তাঁকে কুপিয়ে খুন করে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান তিনি। পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহের দাবি, ‘‘মুখোশ পরা চার দুষ্কৃতী এই হত্যায় জড়িত।’’ সিলেট বিমানবন্দর থানার ওসি গৌসুল হোসেন জানিয়েছেন, ‘‘খুনিরা পিছন থেকে হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে।’’ চিকিৎসকেরা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছেন অনন্ত। আঘাতের জেরে তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরের অংশ বেরিয়ে এসেছিল।
আল কায়দা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) এই হত্যার দায় নিয়েছে বলে সংবাদ সংস্থার দাবি। তবে আর একটি সূত্র জানাচ্ছে, আনসার বাংলা ৭ নামে এক জঙ্গি গোষ্ঠী টুইটারে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ রয়েছে আনসারুল্লা বাংলা টিমের। যারা আল কায়দার সঙ্গেই যুক্ত বলে আগে জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা।
অভিজিতের মতোই বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী লেখালেখিতে মগ্ন থাকতেন অনন্ত। সম্পাদনা করতেন ‘যুক্তি’ নামে একটি পত্রিকা। অভিজিতের এক বইয়ের ভূমিকাও লেখেন তিনি। বছর দুয়েক আগে তসলিমা নাসরিনের প্রশংসায় কবিতা লিখেছিলেন অনন্ত। তসলিমা জানতেন না সে কথা। অনন্তর মৃত্যুর খবরে ফেসবুকে তসলিমা লিখেছেন, অভিজিৎ বা ওয়াশিকুর ফেসবুকে বন্ধু হলেও অনন্তর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কবিতাটি পড়ে চোখে জল এসে গিয়েছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অনন্তের। পরে যোগ দেন ব্যাঙ্কে। ২০১৩-য় ঢাকার শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সিলেটে গড়ে তোলা হয় গণজাগরণ মঞ্চ। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন অনন্ত। এই সংগঠন আগামিকাল ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে। এই মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের অভিযোগ, ‘‘সরকার ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অনন্তবিজয় দাসকে খুন করা হয়েছে।’’ তাঁর মতে, সরকারের ভিতরের লোকেরাই এই ধরনের খুনে জড়িত। না-হলে একের পর এক হত্যা সম্ভব নয়।
অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত— জঙ্গি রোষে নিহত লেখকদের তালিকাটা ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে সরব হলেই মরতে হবে, বার্তা স্পষ্ট জঙ্গিদের। আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিমকে ২০১৩-য় গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকেই ৮৪ জনের নামের একটি তালিকা মেলে। যাতে অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে অনন্তর নামও ছিল। পুলিশের হাতে তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন একের পর এক নৃশংস হত্যা এড়ানো যাচ্ছে না— প্রশ্ন উঠছে সর্ব স্তরে।