পাকিস্তান স্বপ্ন দেখছে, এক জন দুর্নীতিমুক্ত মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন। ছবি: রয়টার্স।
ছাব্বিশ বছর আগে মার্চের একটা দিন। লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানির চোখ টিভির পর্দায়। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সে দিন ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করতে নেমেই ঝোড়ো ইনিংস খেললেন পাক অধিনায়ক। তার পর দ্বিতীয় ইনিংসে টার্গেটের থেকে ২২ রান কমে গুটিয়ে গেল ইংল্যান্ড। কাপ হাতে পাক অধিনায়ক সে দিন বলেছিলেন, ‘‘ক্রিকেট জীবনের গোধূলি লগ্নে দাঁড়িয়ে এই জয় আমার বহু দিনের স্বপ্নকে পূরণ করবে। একটা ক্যানসার হাসপাতাল বানানোর স্বপ্ন।’’
হ্যাঁ, এটাই ইমরান খান। একটি স্বপ্নপূরণের মুহূর্ত, বা তার আগে থেকেই, যিনি পরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেন। এক বারই ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছে পাকিস্তান। তাঁর নেতৃত্বে। তিনিই তৈরি করেছেন দেশের প্রথম ক্যানসার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, মায়ের স্মৃতিতে। এই সব স্বপ্নপূরণের পিছনে প্রধান চালিকাশক্তি ছিল— ইমরানের চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস।
১৯৯৬ সালে তৈরি করেছিলেন ‘পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই)’। তার এক বছর পরে ভোটে একটি আসনও জেতেনি দল। হেরে যান ইমরানও। কিন্তু ক্রিকেটের বাইশ গজের মতো রাজনীতির ময়দানেও হারতে শেখেননি তিনি। তাই কাল যখন গণতন্ত্রের পরীক্ষা দেবে দেশ, আমার মনে হয় তখন ইমরান-ঝড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে শাহবাজ় শরিফ ও বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারির পক্ষে।
পাকিস্তানের প্রতিটা শহর পিটিআইয়ের লাল, কালো আর সবুজ রংয়ে সেজে উঠেছে।ছবি: এএফপি
পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৭২টি আসনের পাশাপাশি কাল একই সঙ্গে ভোট চারটি প্রাদেশিক আইনসভাতেও। মসনদের প্রধান তিন দাবিদারের অন্যতম পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারি। তবে লড়াইটা মূলত ইমরান-শাহবাজ়ের মধ্যেই হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। যদি কোনও কারণে শরিফের দল পিএমএল-এন বা ইমরানের পিটিআই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, সে ক্ষেত্রে অন্য কোনও দলের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসতে পারেন তিরিশ ছুঁইছুঁই ভুট্টো। গত কয়েক মাসের প্রাক নির্বাচনী জনমত সমীক্ষায় যদিও তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাল্লা ভারী ইমরানের। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের একাংশ খুল্লমখুল্লাই বলছেন, ‘‘গত বার শরিফের দলকে ভোট দিয়েছিলাম। কিন্তু ৫ বছর ধরে যা ভুগেছি, এ বার তাই ভোট দেব পিটিআই-কেই।’’
প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের উন্নয়নকেই হাতিয়ার করেছে ইমরানের দল। ২০১৩ থেকে তারাই প্রদেশটির ক্ষমতায় থেকেছে। তবে সেখানকার বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ‘ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো’। তবু ভোটের ময়দানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্জাব প্রদেশ জেতার ক্ষেত্রেও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিকেই হাতিয়ার করতে চাইছে ইমরানের দল।
তবে কূটনীতিকদের একাংশের অভিযোগ, ইমরান খানকে জেতাতে এ বার জান লড়িয়ে দিচ্ছে পাক সেনা। সেনা সূত্রের খবর, ৪ লক্ষ পুলিশের সঙ্গে কাল বুথে-বুথে পাহারা দেবে প্রায় ৪ লক্ষ সেনা। দেশের ইতিহাসে ভোটের দিনে এত বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন এই প্রথম। সেটাও ভাবাচ্ছে একাংশকে। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া যদিও দাবি করেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক আমাদের দায়িত্ব শুধু বুথে-বুথে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা।’’
দ্বৈরথপুষ্ট পাক রাজনীতিতে ইমরান যে ক্রমশ শক্তিমান ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ হয়ে উঠবেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল সেই ২০১১ সালে। বেশ মনে পড়ছে, লাহৌরে পিটিআইয়ের এক জনসমাবেশে সে বার লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয়েছিল। সেই সমাবেশ থেকেই ‘নয়া’ পাকিস্তান গড়ার বার্তা দিয়েছিলেন ইমরান। দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, নবীন পাকিস্তান। ইমরানের নিজের ‘স্বচ্ছ’ ভাবমূর্তি তাঁর দলকে এই দিশা দেখাতে এবং দেশকে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছে। ভোটের কয়েক দিন আগে প্রাক্তন দ্বিতীয় স্ত্রী রেহাম খানের বইয়ে হরেক কুৎসাও যে ভাবমূর্তিতে বিশেষ কালি লাগাতে সফল হয়নি।
আজ যে পাকিস্তানের প্রতিটা শহর পিটিআইয়ের লাল, কালো আর সবুজ রংয়ে সেজে উঠেছে, আর টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে শুধু-ই ইমরান আর তাঁর ‘এ বারের পাকিস্তান সকলের পাকিস্তান’ স্লোগান, তার একমাত্র কারণ, ৯,২০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক দেনায় ডুবে থাকা পাকিস্তান স্বপ্ন দেখছে, এক জন দুর্নীতিমুক্ত মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন।
নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা আগে দাঁড়িয়ে আমার অন্তত মনে হচ্ছে, ইমরান খানই সেই মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy