ইজ়রায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা হয়েছে ১০ অক্টোবর। তার পরে ১৫ দিন কেটে গেলেও গাজ়াবাসীর জীবন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়। অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাটুকু মিলবে কি না, সে বিষয়েও কোনও আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই যেমন গাজ়ার নাসের হাসপাতালের দু’টি আলাদা বিভাগে ভর্তি রয়েছে ১০ বছরের দুই বালক। এক জনের মাথায় টিউমার। আর এক জন শিরদাঁড়ায় ইজ়রায়েলি বুলেটের আঘাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দু’জনেরই জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। বেশ জটিল সেই প্রক্রিয়া। গাজ়ার ভেঙে পড়া হাসপাতালে ওই পরিকাঠামো নেই। একমাত্র উপায় বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো। অন্য দিকে, সংঘর্ষবিরতি চালু হলেও হামাসের বিরুদ্ধে শর্তভঙ্গের অভিযোগ তুলে ইজ়রায়েল এখনও সেনা প্রত্যাহার করেনি। খুলে দেয়নি সীমান্তও। ফলে চিকিৎসা কবে মিলবে, আদৌ মিলবে কি না— সেই আশা-আশঙ্কায় দিন গুনছে অসুস্থ শিশুরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে জানানো হয়েছে, এমন অন্তত ১৫ হাজার রোগী গাজ়া ভূখণ্ডে অপেক্ষা করছে।
ইজ়রায়েলি বুলেটে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ১০ বছরের আমেরের পাশে বসে মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলেন তার বাবা ওলা আবু। জানালেন, যুদ্ধ চলাকালীন তাঁরা দক্ষিণ গাজ়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে ইজ়রায়েলি ড্রোন থেকে ছোড়া বুলেট আচমকা ছুটে এসে লাগে আমেরের শিরদাঁড়ায়। তার পর থেকেই সে শয্যাশায়ী।
মাথায় টিউমার নিয়ে নাসের হাসপাতালে আমেরর পাশের ওয়ার্ড ভর্তি রয়েছে আহমেদ অল-জ়াদ। তার দিদি শাদ জানালেন, যুদ্ধের সময় ১০ বছরের অতটুকু ছেলে জল বিক্রি করে পরিবারের পাশা দাঁড়িয়েছিল। কয়েক মাস আগে হঠাৎ বলতে শুরু করল, মাথায় ব্যথা। তার পর এক দিন মুখের একাংশ ঝুলে পড়ল। অকেজো হয়ে গেল ডান হাতটি। চিকিৎসকেরা জানালেন, জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু গাজ়ায় তা সম্ভব নয়। শাদ বললেন,‘‘বাবাকে আগেই হারিয়েছে। ঘর-বাড়ি, ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাইকে হারাতে পারব না। সংঘর্ষ বিরতি চালু হতে ১ শতাংশ হলেও আশা জেগেছিল যে ভাইকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারব। তবে কবে পারব তা এখনও জানি না।’’
সংঘর্ষবিরতি চালু হওয়ার পর গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই প্রথম গাজ়া থেকে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স আর বাসে করে বার করে এনেছে। ইজ়রায়েলের কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে ৪১ জন রোগী ও ১৪৫ জন পরিজনকে জর্ডনে পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে জানানো হয়েছে, মিশরের প্রান্তঘেঁষা রাফা সীমান্ত খুলে দিলে হাজার হাজার রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করা যাবে। এ দিকে ইজ়রায়েল জানাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে সমস্ত মৃত পণবন্দির দেহ ফিরিয়ে দেয়নি হামাস। তাই সীমান্ত তারা খুলবে না।
যুদ্ধের আগে পূর্ব জেরুসালেম আর ওয়েস্টব্যাঙ্কে গাজ়ার প্রচুর মানুষ চিকিৎসা করাতে আসতেন। সেখানের এক চিকিৎসক ফাদি আতরাস বলেন, ‘‘ইজ়রায়েল এই রাস্তা খুলে দিলে শত শত মানুষকে দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবা দিতে পারব। প্রতি দিন অন্তত ৫০ জন কেমোথেরাপি-সহ অন্য চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। কারণ, গাজ়া থেকে পূর্ব জেরুসালের দূরত্ব খুব বেশি নয়। আমরা এক ভাষায় কথা বলি। সংস্কৃতির মিল রয়েছে। অনেক রোগী আগেও এখানে চিকিৎসা করিয়েছেন। ফলে তাঁদের ফাইলও রয়েছে আমাদের কাছে।’’
ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে রোগী আসতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে এর কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
গাজ়ার নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক আহমেদ অল-ফারা এই বললেন, ‘‘কী রোগ হয়েছে ধরতে পারছি, অথচ পরিকাঠামোর অভাবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারছি না, চিকিৎসা শুরু করতে পারছি না, চিকিৎসক হিসেবে এর থেকে হতাশাজনক আর কিছু হতে পারে না।’’ সংঘর্ষবিরতি শুরু হলেও রোগীরা আর ধৈর্য্য রাখতে পারছেন না। গত কয়েক সপ্তাহে চিকিৎসার অভাবে ওই হাসপাতালেই মারা গিয়েছে ক্যানসার আক্রান্ত ৮ বছরের সাদি আবু তাহা। মৃত্যু হয়েছে জন্ডিসে আক্রান্ত ৩ বছরের ছোট্ট জ়াইন তাফেস, ৮ বছরের লুয়েই দুইকের। চিকিৎসা-না-পাওয়া এমন বহু গাজ়ার শিশু এখনও মৃত্যুর অপেক্ষায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)