Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
China

বুদ্ধ-রবীন্দ্রে আধ্যাত্মিকতা চর্চায় চিনা কমিউনিস্টরা

একান্ত আলাপে চিনের কনসাল জেনারেল চা-র যুক্তি— আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিনের ধারণা ভারতীয় ধারণার সঙ্গে অনেকটাই মেলে, আবার অমিল রয়েছে ধর্মাচরণের প্রশ্নে।

শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ইতিমধ্যে এই আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনে সুফল পেয়েছেন।

শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ইতিমধ্যে এই আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনে সুফল পেয়েছেন। ফাইল চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৫১
Share: Save:

মুক্ত বাজার অর্থনীতির কুশলী ব্যবহারে অবিশ্বাস্য দ্রুত আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে চিন। পুঁজির প্রতিযোগিতায় ঘুম ছুটিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার। এ বার আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন শুরু করছে প্রতাপশালী কমিউনিস্ট দেশটি। লক্ষ্য সচেতন মূল্যবোধের বিনির্মাণ। এ জন্য তারা মুখ ফেরাচ্ছে ভারতের দিকেই। সদ্য শেষ হওয়া চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসের চাওয়া-পাওয়া ব্যাখ্যা করতে সম্প্রতি কলকাতায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন চিনের কনসাল জেনারেল চা লিইয়। সেখানেই তিনি জানান— কারিগরি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধিকেও পার্টি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে শতবর্ষী চিনা কমিউনিস্ট পার্টি।

শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ইতিমধ্যে এই আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনে সুফল পেয়েছেন। এ বিষয়ে আলোকবর্তিকা হিসাবে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বেছে নিয়েছে গৌতম বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী ও ভাবধারাকেও। মোদ্দা কথা— তাইওয়ান, উইগুর, গণতন্ত্র, প্রশান্ত মহাসাগরের আধিপত্য নিয়ে রোজকার অশান্তি, আমেরিকার নিত্য চোখ রাঙানির মধ্যে শি ও সহযোগী নেতাদের অবিচল রাখে আধ্যাত্মিকতার চর্চা। কংগ্রেস থেকে তা বৃহদর্থে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চিন। যদিও সত্তরের দশকে ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ বলা ভারতের সিপিআই (এমএল) বলছে, চিনের বর্তমান নেতৃত্বের উপরে তাদের কোনও ভরসা নেই। পার্টি কর্মসূচিতে আধ্যাত্মিকতা অনুশীলনের বিষয়টিই গোলমেলে।

দেং শিয়াওপিংয়ের নেতৃত্বে চিনের পার্টি ও সরকার বাজার অর্থনীতিতে হাত পাকাতে নামার পরে তারা কতটা কমিউনিস্ট, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে ছাড়েনি ভারতের মার্ক্সবাদীদের একাংশ। চিনা পার্টি অবশ্য তাদের ‘চিনা সমাজতন্ত্রের’ পথেই এগিয়েছে, অভূতপূর্ব সাফল্য ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেই সমৃদ্ধি দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং বর্তমান পার্টি কংগ্রেসে ঘোষণা করেছে— দারিদ্র থাকলেও হতদরিদ্র মানুষ আর সে দেশে নেই। দরিদ্র এলাকাকে চিহ্নিত করে দারিদ্রের কারণগুলিকে মোকাবিলার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে পার্টি কংগ্রেসে।

কিন্তু আধ্যাত্মিকতা? ধর্ম অহিফেন ইত্যাদি?

একান্ত আলাপে চিনের কনসাল জেনারেল চা-র যুক্তি— আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিনের ধারণা ভারতীয় ধারণার সঙ্গে অনেকটাই মেলে, আবার অমিল রয়েছে ধর্মাচরণের প্রশ্নে। প্রচলিত ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় সব চেয়ে বড় প্রভাব ধর্মের। ভারতে ধর্মাচরণ হয় বহু জাঁকজমকে। চিনের আধ্যাত্মিকতায় ধর্ম থাকলেও তা পালিত হয় একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে। কনসাল জেনারেল জানান— চিনের পার্টি মনে করে, আধ্যাত্মিকতা মানুষকে তার সভ্যতার মূলে ফেরায়। দেশ, কাল, সমাজ ও সর্বোপরি নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরি করে, যা পশ্চিমি ‘অপব্যয় ও প্রকট উদযাপনের মূল্যবোধ’-এর বিপ্রতীপ।

চা জানালেন, শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে এই ‘নিজেকে চেনো, সমাজকে চেনো’ অনুশীলন তাঁদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। জাগতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবারের বন্ধনকে অটুট রাখতে যে মূল্যবোধ প্রয়োজন, তা মেলে আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনে। ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে মানুষ দু’দণ্ড স্বস্তি পান। আধ্যাত্মিক অনুশীলন পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা গড়ে তোলে, যা সমাজকে শান্ত রাখে। চা জানালেন, এই মুহূর্তে যে দু’টি মস্ত সমস্যা জনবহুল চিনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে— তার প্রথমটি পরিবেশ রক্ষা, দ্বিতীয়টি দুর্নীতির মোকাবিলা। আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি ও মূল্যবোধ প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা ও রক্ষা করতে শেখায়। নির্মল জীবনযাপনের সংস্কৃতি শেখায়। আবার মানুষকে দুর্নীতির প্রলোভনে পড়া থেকে রক্ষা করে যে মূল্যবোধ, তা গঠন করতে পারে আধ্যাত্মিকতা।

ভারতের সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য অবশ্য জানালেন মুক্ত বাজার নীতি নিয়ে চলা চিনের নেতৃত্বের উপরে তাঁর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। আধ্যাত্মিক চর্চা তাদের পার্টি লাইন হলে, ধরে নিয়ে গিয়ে জোর করে এই কাজ করানো শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, “এই সমষ্টিগত চর্চার বিষয়টিই গোলমেলে। পার্টির নির্দেশে কেন আধ্যাত্মিক চর্চা করতে হবে!” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা সাবধানী সুরে জানান, দল হয়তো আরও আলোচনা করে এ বিষয়ে কথা বলতে পারে। তাঁর পক্ষে খতিয়ে না-দেখে মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীরা তো অনেক শিক্ষনীয় কথা বলে গিয়েছেন। তা যদি মূল্যবোধের জন্ম দেয়— আপত্তির কারণ থাকে না।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার সাফ কথা, “আধ্যাত্মিক অনুশীলন যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, ইতিবাচক ধারণার চর্চা হয়, তা যদি চরিত্র গঠনে সাহায্য করে, পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি ভালবাসা শেখায়— সে তো ভাল কথা। চিন যদি রবীন্দ্রনাথের চর্চা, বুদ্ধের বাণী নিয়ে অনুশীলন করতে চায় সাধু প্রস্তাব। এমনকি কনফুসিয়াসের নীতিকথা চর্চাও চলতে পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

China Chinese Communist Party
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE