এক বাঙালি থাকতেন আটলান্টিকের পূর্বে। এখন চলে গিয়েছেন সিরিয়ায়।
আর এক বাঙালি থাকছিলেন আটলান্টিকের পশ্চিমে। বৃহস্পতিবার আত্মঘাতী হয়েছেন।
আটলান্টিকের পূর্বে যিনি থাকতেন, তাঁর জন্ম সেখানেই— লন্ডনে। জীবনের তিরিশটা বসন্ত সবে পার করেছেন তিনি।
আটলান্টিকের পশ্চিমের জন কিন্তু খাঁটি বাঙালি। জন্ম রাঢ়বঙ্গে। মেধায় সওয়ার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে মিনেসোটায়।
প্রথম জন সিদ্ধার্থ ধর ওরফে আবু রুমায়েশ। দ্বিতীয় জন মৈনাক সরকার। দু’জনের মধ্যে বিস্তর অমিল। কিন্তু মৈনাক আমেরিকায় নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে এবং এক অধ্যাপককে গুলি করে খুন করার পর অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে সিদ্ধার্থ ধরের কথা।
আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুলে বা জনবহুল স্থানে হঠাৎ বন্দুকবাজের হানা খুব বিরল ঘটনা নয়। একাধিক বার মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহর আন্তর্জাতিক শিরোনামে উঠে এসেছে এই বন্দুকবাজদের হানার কারণে। কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে কোনও বাঙালি পড়ুয়া বা গবেষক আচমকা বন্দুকবাজ হয়ে উঠেছেন, এমন ঘটনা বেনজির। প্রবাসী বাঙালি সম্পদ্রায়ের খ্যাতি চিরকালই বুদ্ধিবৃত্তির জন্য। মেধায় ভর করে বহু বাঙালিই পাড়ি দেন আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, আরও নানা দেশে। বিদেশে গিয়ে বাঙালি কতটা সফল হয়েছেন, কেমন অসামান্য কৃতিত্বের নজির গড়েছেন, সে সব খবর মাঝেমধ্যেই শিরোনামে আসে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন, এমন খবর সচরাচর মেলে না। সেই কারণেই সিদ্ধার্থ ধরের জঙ্গি হয়ে ওঠার খবর প্রকাশ্যে আসতেই চমকে উঠেছিল বাঙালি।
১৯৮৪ সালে লন্ডনেই জন্ম সিদ্ধার্থের। পরিবার হিন্দু হলেও সিদ্ধার্থ ইসলামে ধর্মান্তরিত হন এবং আবু রমায়েশ নাম নেন। লন্ডনেই আয়েশা নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। সিদ্ধার্থের পরিজনদের অভিযোগ, আয়েশার সঙ্গে প্রণয়ের পরই মতিগতি পাল্টাতে শুরু করেছিল সিদ্ধার্থের। আল মুহাজিরোঁ নামে একটি সংগঠনের হয়ে কাজ করতে শুরু করেছিল সে। ব্রিটেনে শরিয়তি শাসনের দাবিতে পথে নেমে মিটিং-মিছিল করতেও দেখা যেত তাকে। সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতারও করেছিল লন্ডনের পুলিশ। কিন্তু জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরই সে ব্রিটেন ছেড়ে পালায়। প্যারিস হয়ে চলে যায় সিরিয়ায়। এ বছরের গোড়ায় আইএস ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। তাতে দেখা গিয়েছিল, পাঁচ বন্দিকে খুন করছে এক আইএস জঙ্গি। ব্রিটেনের গোয়েন্দারা ওই জঙ্গিকেই আবু রুমায়েশ ওরফে সিদ্ধার্থ ধর হিসেবে চিহ্নিত করে।
টেমসের মুলুকে প্রবাসী বাঙালি পরিবারে জন্ম নেওয়া যুবকের ধর্ম পরিবর্তন এবং এবং জঙ্গি সংগঠনে যোগদানের খবর সামনে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল গঙ্গাপাড়েও। এও হয়! প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি এমন সাংঘাতিক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে? বাঙালির ছেলে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার হাতে পেয়েও এমন ভাবে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে জঙ্গি হওয়ার জন্য? এমন নানা আলোচনা, সমালোচনা, বিস্ময়, নিন্দা, প্রশ্ন ঝড় তুলে দিয়েছিল বাংলায়। আবার সেই ঝড় উঠল। এ বার ঝড়ের কারণ মৈনাক।
আরও পড়ুন:
আমেরিকার বন্দুকবাজ বাঙালি মৈনাক সরকার
মৈনাক এখন গৌণ, আমেরিকায় শুরু তুমুল জাতিবিদ্বেষী তর্ক
মৈনাকের সঙ্গে সিদ্ধার্থের অমিল কিন্তু বিস্তর। মৈনাক বিদেশে জান্মাননি। দুর্গাপুরে জন্ম। সেখানেই স্কুলের পাঠ। তার পর খড়্গপুর আইআইটি। তার পর বেঙ্গালুরুতে কিছু দিন চাকরি করা। তার পর আরও উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেওয়া। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) থেকে তিনি নিজের গবেষণাও শেষ করেছিলেন সফল ভাবেই। থাকছিলেন মিনেসোটায়। কিন্তু গবেষণায় মৈনাকের গাইড ছিলেন যিনি, সেই অধ্যাপক উইলিয়াম ক্লুগ, আরও এক অধ্যাপক এবং নিজের প্রাক্তন স্ত্রী অ্যাশলে হ্যাসটি— এই তিন জনের নাম ‘খতম তালিকা’য় তুলেছিলেন মৈনাক। সে তালিকা অবশ্য পরে উদ্ধার হয়েছে। তার আগেই অ্যাশলে এবং ক্লুগকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন মৈনাক।
উইলিয়াম ক্লুগের বিরুদ্ধে নিজের ব্লগে কিছু দিন ধরেই গুরুতর অভিযোগ আনছিলেন মৈনাক। কিন্তু তিনি যে ক্লুগকে খুনের ছক কষেছেন, তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। অ্যাশলে হ্যাসটিকে কেন খুন করলেন মৈনাক, তাও এখনও জানা যায়নি। তৃতীয় যে ব্যক্তির নাম খতম তালিকায় ছিল, তাঁকে আক্রমণের কোনও চেষ্টা অবশ্য মৈনাক করেননি। দু’জনকে খুনের পরই মৈনাক আত্মঘাতী হন।
সব মিলিয়ে মৈনাক সরকারের কাণ্ডকারখানা ঘিরে ধোঁয়াশা অনেক। কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকেই এমন ভয়ঙ্কর কাণ্ড তিনি ঘটিয়েছেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে মার্কিন পুলিশও। সিদ্ধার্থের মতো কোনও জঙ্গি কার্যকলাপ বা সংগঠিত সন্ত্রাসের সঙ্গে মৈনাকের কোনও যোগ নেই। তা সত্ত্বেও তুলনাটা এসেই যাচ্ছে। বাঙালি প্রবাসে গিয়ে এমন কাণ্ডও ঘটাতে পারে? বিস্ময় গোটা বাংলাতেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy