Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূলে কিন্তু পৌঁছতে পেরেছেন ট্রাম্প

রাত এগারোটা থেকেই টিভিতে দাপুটে পোলস্টারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোটের ফল-কে যাঁরা বাঁ হাতের খেল বলে চ্যানেলে-চ্যানেলে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, তাঁরা আমতা আমতা আত্মসমীক্ষণে ব্যস্ত।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
শিকাগো শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

রাত এগারোটা থেকেই টিভিতে দাপুটে পোলস্টারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোটের ফল-কে যাঁরা বাঁ হাতের খেল বলে চ্যানেলে-চ্যানেলে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, তাঁরা আমতা আমতা আত্মসমীক্ষণে ব্যস্ত। মিডিয়ায় বারবার শোনা যাচ্ছে, আটলান্টিক পারের একটা শব্দ। ব্রেক্সিট। কথাটা ক’দিন আগে চালু করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, এ বারের ভোট হবে ব্রেক্সিট প্লাস প্লাস। ‘পাণ্ডিত্যকে তুড়ি মেরে পপুলিজমের জয়’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে কথাটা এ বার ইংরেজি অভিধানে ঢুকল বলে।

হিলারি ক্লিন্টন গভীর রাতে নিউ ইয়র্কে সমর্থকদের নিয়ে পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। সমর্থকরা ভিড় করেছিলেন বিজয়োৎসব দেখবেন বলে। টিভিতে দেখা যাচ্ছে, সেই জমায়েতে শ্মশানের নীরবতা। কেউ কাঁদছেন, কেউ থ হয়ে বসে। বাকরুদ্ধ।

বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে গিয়েছেন।

চার দিকে লিবারালদের মধ্যে একটা অদ্ভুত অবিশ্বাসের আবহ। যেন ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছে ঘরদোর। সোশ্যাল মিডিয়া লিখছে, আরআইপি আমেরিকা। এক জন তো সখেদে লিখলেন, একই বছরে মহম্মদ আলি, আমেরিকা দু’জনেই প্রয়াত। নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি বন্ধু মধ্যরাতে ফোন করল। ‘‘সত্যিই মুসলিমদের তাড়িয়ে দেবে নাকি?’’ প্রশ্নটা করেই রেখে দিল ফোন। যেন উত্তরটা নয়, শুধু প্রশ্নটাই দরকারি। সকালে পাড়ার গ্যাস স্টেশনে লাইটার কিনতে গিয়ে দেখি মুখচেনা মেয়েটি থম মেরে বসে আছে। এমনিতে লেননের ভক্ত, দেখলেই হইচই করে ওঠে। আজ শুকনো মুখে কেবল জিজ্ঞেস করল, ‘‘কী রঙের লাইটার দেব?’’ বললাম, ‘‘যা খুশি।’’ মেয়েটি বলে, ‘‘ডোন্ট গো ফর আ পিঙ্ক ওয়ান। জেন্ডার স্টিরিওটাইপিং ইজ ব্যাক।’’

দোকানবাজার, ইন্টারনেট, অফিসে নানা গুজব। শেয়ার বাজার চড়চড়িয়ে নামছে। এত হিট হয়েছে যে, কানাডার ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত খবরাখবরের ওয়েবসাইট রাতেই তিন বার ক্র্যাশ করেছে। শুনেই মনে পড়ে পরিচিত এক শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপককে বলতে শুনেছিলাম, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বিদেশে পাড়ি দেবেন। ইউরোপ কিংবা কানাডায়। ট্রাম্প প্রেসিডেন্সিতে বাঁচা অসম্ভব। এই অগুনতি হিটের মধ্যে একটা তাঁর কি? স্যামুয়েল জনসন, মাইলি সাইরাস, হুপি গোল্ডবার্গরাও তো একই কথা বলছেন, এ দেশে আর থাকা চলে না!

অনেক মিথের মৃত্যু হচ্ছে, জন্ম হচ্ছে অজস্র রূপকথার। আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টকে দেখার স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা নাকি ঢেলে হিলারিকে ভোট দেবে বলে ভাবা গিয়েছিল, দেয়নি। একটি পুরুষ আর একজন পুরুষের সঙ্গে কী ‘লকার রুম টক’ করেছে, তাদের কিছু যায় আসেনি। মধ্যপন্থী এক লিবারাল খবর দেন, বার্নি স্যান্ডার্স আর এলিজাবেথ ওয়ারেনের নেতৃত্বে কট্টর বামপন্থীরা নাকি ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দখল করে নেবে। পার্টি ভেঙে যেতে পারে। এ সবের সত্যি-মিথ্যে কেউ জানে না। কিন্তু সোশাল মিডিয়া-সম্পৃক্ত দুনিয়ায় মিথের এ ভাবেই জন্ম হয়। তার কোনও কোনওটা সত্যিও হয়ে যায়। ট্রাম্প সমর্থকরা ক’দিন ধরেই বলছিলেন, ওপিনিয়ন পোল মিথ্যে। তাঁদের গোপন ভোট আছে। সে সব তো সত্যিই হয়ে গেল!

এরই মধ্যে মেল আসে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে। নানা বামপন্থী ছোট সংগঠনের কর্মীরা মানববন্ধন করছেন। পড়ে অদ্ভুত লাগে। যারা এক সময় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ ঘটিয়েছিল, বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থানের পিছনে যে সব অনামী সংগঠনের ভূমিকা অতুলনীয়, আজ ওয়াল স্ট্রিটের নিশ্চিত পরাজয়ের দিনে সবচেয়ে ব্যথিত তারাই। ওয়াল স্ট্রিটের সম্পূর্ণ বিরোধীরাই এমন এক প্রার্থীর হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, যিনি ওয়াল স্ট্রিটের অঘোষিত মুখপাত্র। উল্টো দিকে ওয়াল স্ট্রিট বিরোধিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি নিজে বিলিওনেয়ার। ওয়াল স্ট্রিটের বহু অপকর্মের সঙ্গী। এই যুদ্ধে তিনি নিজেকে রাজসাক্ষী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘‘আমি এই সিস্টেমের মধ্যে কাজ করেছি, সমস্ত সুযোগ নিয়েছি। একে বদলাতে একমাত্র আমিই পারি।’’ মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে।

রহস্যটা কী? অফিসের প্রবীণ ট্রাম্প সমর্থক হেসে বলেন, ‘‘হোয়েন দে গো হাই, উই গো টু দ্য রুটস।’’ কথাটা মিশেল ওবামার বিখ্যাত বক্তৃতা থেকে নেওয়া। রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘হোয়েন দে গো লো, উই গো হাই।’’ কথাটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল ডেমোক্র্যাট মহলে। প্রচারের শেষ দিনও ফিলাডেলফিয়ার জনসভায় হিলারি এটা ‘কোট’ করেছিলেন। কে না ছিলেন নক্ষত্রখচিত সেই সভায়! বনজোভি, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, বারাক ও মিশেল ওবামা, বিল ক্লিন্টন...। গান, বক্তৃতা সব নিয়ে উৎসবের আবহ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন খানিকটা অসহায়ের মতোই বলছিলেন, ‘‘নির্বাচনী প্রচারে আমার গিটার-পিয়ানো লাগে না।’’ তখন ট্রাম্পকে কোণঠাসা, অসহায় লেগেছিল। দু’দিন বাদে আজ দেখা যাচ্ছে, উনিই ঠিক। গিটার, পিয়ানো, গান, বাঁধিয়ে রাখার মতো বক্তব্য— কোনওটাই নির্বাচনে কাজে লাগে না। এলিটিজম নয়, আসল কথাটা হল তৃণমূলে পৌঁছনো।

ওয়াশিংটন ডিসি’র বাঁ-দিক ঘেঁষা বন্ধুরা কথাটা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বটে, কিন্তু পাকেচক্রে এই নির্বাচনে সেটা করে উঠতে পারেননি।

আমেরিকা ছাড়ার হিড়িক নাগরিকদের

সংবাদ সংস্থা • ওটাওয়া

আমেরিকার নাগরিকরা ঠাট্টার সুরেই বলেছিলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে দেশ ছেড়ে দেব।’’ বুধবার নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পর সেই ঠাট্টাই বাস্তব হয়ে দাঁড়াল।

ট্রাম্পের জয়ের আভাস আসতেই মঙ্গলবার রাতে কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের অভিবাসনের ওয়েবসাইটে ভিড় বাড়তে শুরু করে। সূত্রের খবর, চাপ সামলাতে না পেরে মঙ্গলবার রাতেই জবাব দিয়ে তিন বার ক্র্যাশ করে কানাডার ওয়েবসাইটটি। টুইটারে এ নিয়ে অভিযোগ জমা পড়লেও সরকারের তরফে কোনও সদুত্তর মেলেনি।

আমেরিকা ছেড়ে নিউজিল্যান্ডেও চলে যেতে চাইছেন অনেকে। নিউজিল্যান্ডে আবাসন এবং ছাত্র ভিসার পরিষেবা দেওয়া একটি ওয়েবসাইট বলছে, গত এক সপ্তাহে আমেরিকার প্রায় ১৬০০ নাগরিক ওই দেশে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। যা, সাধারণ ভাবে এক মাসের হিসেবের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি। মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্পের হিংসাত্বক ও বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের জেরেই এই পরিস্থিতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE