সাফল্যের চাবিকাঠি হামলার আকস্মিকতা। সামরিক পরিভাষায়, ‘এলিমেন্টস অফ সারপ্রাইজ়’। ৮৪ বছর পরে তা আবার প্রমাণ করল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পর্বে ঠিক যেমনটা করে দেখিয়েছিলেন জাপানি অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো এবং তাঁর বাহিনী। ঝটিতি হামলায় তছনছ করে দিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে মার্কিন নৌবাহিনীর বন্দর এবং বিমানঘাঁটি।
১৯৪১-এর ৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টা ৪৮। পার্ল হারবারে বিমানহানা শুরু করেছিল জাপানি ‘ফার্স্ট এয়ার ফ্লিট’। পরের সাত ঘণ্টায় ছ’টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে মোট ৩৫৩টি বিমান কার্যত দুরমুশ করেছিল ওই মার্কিন নৌ ও বিমানঘাঁটি। ডুবে যায় তাদের চারটি যুদ্ধজাহাজ এবং দু’টি সামরিক পরিবহণ জাহাজ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফ্রিগেট, ক্রুজ়ার, ডেস্ট্রয়ার জাতীয় আরও ১০টি যুদ্ধজাহাজ। ধ্বংস হয়েছিল ১৮৮টি বিমান। নিহত হয়েছিলেন ২,৪০৩ জন মার্কিন সেনা। জাপানি ভাষায় সেই অভিযানের সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘টোরা টোরা টোরা’।

(উপরে) ‘পার্ল হারবার’ হামলার দৃশ্য। রবিবার রাশিয়ার চারটি বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার পরের ছবি (নীচে)।) ছবি: সংগৃহীত।
পরবর্তী সময়ে ওই নামে একটি জাপানি সিনেমাও হয়েছিল। আবার ঝটিতি হামলার মুখে মার্কিন বাহিনীর প্রতিরোধের কথা তুলে ধরতে হলিউড বানিয়েছিল ‘পার্ল হারবার’। বস্তুত, ১৯৪১ সালের ওই হামলার পরেই সক্রিয় ভাবে জার্মানি-জাপান-ইটালির ‘অক্ষশক্তি’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল ওয়াশিংটন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যা অন্যতম অনুঘটক হয়েছিল। অনেকে বলেন, পার্ল হারবারে লজ্জাজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই চার বছর পরে ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। ঘটনাচক্রে, রবিবার রাশিয়ার পাঁচটি বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার পরে ক্রেমলিন ‘পরমাণু প্রত্যাঘাতের’ ভাবনাচিন্তা করছে বলে কয়েকটি পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের দাবি।
তবে পার্ল হারবারে জাপানি বোমারু বিমানের ঝাঁকের প্রবল আক্রমণের মুখেও রানওয়েতে দাঁড় করানো কয়েকটি যুদ্ধবিমানকে উড়িয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করেছিলেন কেনেথ এম টেলর, জর্জ ওয়েলচের মতো অকুতোভয় মার্কিন পাইলটেরা। ২০০১ সালের হলিউডি ব্লক ব্লাস্টার ‘পার্ল হারবারে’ বেন অ্যাফ্লেক এবং জোশ হার্টনেট অভিনয় করেছিলেন ওই দুই অসমসাহসী মার্কিন ফাইটার পাইলটের চরিত্রে।
কিন্তু রবিবার ইউক্রেনের এফপিভি ড্রোনের ‘ঢেউ’ আছড়ে পড়ার সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনী সময়োচিত দক্ষতা দেখাতে পারেনি। কার্যত বিনা প্রতিরোধেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তাদের বেশ কিছু বোমারু ও নজরদারি বিমান! টিইউ-৯৫এমএস, টিউ-২২এম৩-এর মতো পরমাণু স্ত্র বহনে সক্ষম গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’ রয়েছে সেই তালিকায়। এ ছাড়া রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা সামরিক নজরদারি বিমান এ-৫০। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রানওয়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
ইউক্রেনের দাবি, তাদের ‘অপারেশন স্পাইডারওয়েব’ রাশিয়ার অন্তত ৭০০ কোটি ডলারের সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করেছে। ঘটনাচক্রে, গত সপ্তাহে সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের অন্তত ১৪৭৫ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে বলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছিল। ডনেৎস্ক এলাকার স্টারায়া নিকোলায়েভকা জনবসতি পুতিনের বাহিনী মুক্ত করেছে বলে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমও জানিয়েছিস। তার আগে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ইউক্রেন সেনার হাত থেকে কুর্স্ক ভূখণ্ড পুনর্দখল করেছিল রুশ বাহিনী। রবিবার মুরমানস্ক, ইরকুটস্ক, ইভানোভো, রিয়াজান এবং আমুর অঞ্চলের মোট পাঁচটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার জবাবে রুশ ফৌজ মরিয়া হয়ে জ়েলেনস্কিকে উৎখাতের জন্য কিভ দখলের অভিযানে নামতে পারে বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।