Advertisement
E-Paper

চিহ্নিতই করা নেই সীমান্ত, সঙ্ঘাতের বীজ ৩ হাজার ৩৮০ কিমি জুড়ে

ভারত-চিন সীমান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত সীমান্তগুলোর অন্যতম— এমন একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল প্রতিরক্ষা বিশারদদের মধ্যে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ ১৮:৩৮
সোমবার রাতে গলওয়ান উপত্যকায় হামলা চালাতে এসে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যাঘাতে খতম হয়েছে পাঁচ চিন সেনা। হামলায় ভারতীয় সেনার এক কর্নেল এবং দুই জওয়ান শহিদ হয়েছেন।

সোমবার রাতে গলওয়ান উপত্যকায় হামলা চালাতে এসে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যাঘাতে খতম হয়েছে পাঁচ চিন সেনা। হামলায় ভারতীয় সেনার এক কর্নেল এবং দুই জওয়ান শহিদ হয়েছেন।

গুলি-গোলা চলে না, অতএব ভারত-চিন সীমান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত সীমান্তগুলোর অন্যতম— এমন একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল প্রতিরক্ষা বিশারদদের মধ্যে। দুই বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি, পাথর ছোড়াছুড়ির দৃশ্য সামনে এসেছে অনেক বারই। কিন্তু সীমান্তে কোনও পক্ষই গুলি চালাবে না, এমন সমঝোতাও ভারত-চিনের মধ্যে রয়েছে। অতএব গুলি চলে না, সংঘর্ষ প্রাণঘাতী আকার নেয় না। সোমবার শেষ রাতে যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে, তার পরে কিন্তু ভারত-চিন সীমান্তকে আর ‘শান্তিপূর্ণ’ আখ্যা দেওয়া কঠিন হচ্ছে সমর বিশেষজ্ঞদের অনেকের পক্ষেই। গুলিগোলা না চললেও অশান্তির বীজ শুরু থেকেই পোতা রয়েছে ভারত-চিন সীমান্তে, বলছেন তাঁরা।

লাদাখ থেকে অরুণাচল পর্যন্ত ভারত-চিন সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার। ভারতের স্বাধীনতার সময়ে বা চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে কিন্তু এতটা দীর্ঘ সীমান্ত ছিল না ভারত ও চিনের মাঝে। কারণ মাঝের অধিকাংশ এলাকাটাই ছিল তিব্বত, যার নিয়ন্ত্রণ তখন বেজিঙের হাতে ছিল না। ১৯৫৯ সালে তিব্বতকে পুরোপুরি দখল করে চিন। ফলে ভারত এবং চিন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে ওঠে। আর তখন থেকেই সঙ্ঘাত তৈরি হওয়া শুরু হয়।

যে বছর তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিল চিন, তার ঠিক তিন বছরের মাথাতেই কিন্তু ভারত-চিন যুদ্ধ— ১৯৬২ সালে। বেজিঙের এই আগ্রাসন তথা সম্প্রসারণবাদ যে ভারতের জন্য সমস্যার হয়ে উঠতে পারে, তা ১৯৫৯ সালেই আঁচ করেছিল দিল্লি। তাই নেপালের অনুমতি নিয়ে নেপাল-তিব্বত সীমান্তে বেশ কিছু সামরিক চৌকি বসিয়েছিল ভারত। ১৯৬২-র যুদ্ধে যে হেতু নেপাল-চিন সীমান্ত সে ভাবে তপ্ত হয়নি, সে হেতু ওই চৌকিগুলি খুব কাজে লাগেনি। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর ওই চৌকিগুলিও যে চিনের পছন্দ নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৮ সালে চিন সফর করে আসেন নেপালের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী কীর্তিনিধি বিষ্ট। বেজিঙে গিয়ে মাও জে দং-এর সঙ্গে দেখা করে আসেন তিনি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী হন কীর্তিনিধি এবং নেপাল-চিন সীমান্ত থেকে ভারতীয় সামরিক চৌকিগুলি সরিয়ে নিতে তিনি দিল্লিকে বাধ্য করেন।

লাদাখে হোক বা অরুণাচলে, উত্তরাখণ্ডে হোক বা সিকিমে— কোথাওই স্থায়ী ভাবে চিহ্নিত সীমান্ত নেই। ফাইল চিত্র।

১৯৬২-র যুদ্ধে ভারতের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল লাদাখের অংশ আকসাই চিন। অরুণাচলকে যে হেতু ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে দাবি করে চিন, সে হেতু অরুণাচলের বিস্তীর্ণ অংশেও ঢুকে পড়েছিল চিনা সেনা। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে ভাবে বিনা বাধায় অরুণাচলের মধ্যে দিয়ে অসমের তেজপুরের দিকে এগোতে পেরেছিল চিনা বাহিনী, তাতে সংশয় তৈরি হয়েছিল লালফৌজের কর্তাদের মধ্যে। বিনা বাধায় নিজেদের এলাকায় চিনা বাহিনীকে ঢুকতে দিয়ে পিছন দিক থেকে ‘সাপ্লাই লাইন’ কেটে দিতে পারে ভারত— এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ওই অংশ ছেড়ে চিনা বাহিনী ফিরে যায় দ্রুত। কিন্তু আকসাই চিনে সে রকম কোনও আশঙ্কা ছিল না। চিনা সেনা যত দূর পর্যন্ত ঢুকেছিল, তার পিছন দিকে পৌঁছে ভারতীয় বাহিনী ঘিরে ফেলবে, এমন কোনও রাস্তাই ছিল না বলতে গেলে। ফলে আকসাই চিন ছেড়ে চিন বেরিয়ে যায়নি। এবং তখন থেকেই সীমান্ত নিয়ে বিবাদ রয়ে গিয়েছে।

আকসাই চিন ভারত সরকারের নিন্ত্রণে না থাকলেও ওই অংশকে ভারত নিজেদের মানচিত্রের মধ্যেই দেখায়। ১৯৬২-র যুদ্ধের পরে যে দেশের বাহিনী যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই পর্যন্ত এলাকা সে দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে— এই রকম ভাবেই চলছিল। কিন্তু আকসাই চিনের উপর থেকে নিজের দাবি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে ভারত রাজি হয়নি। ফলে কোনও চিহ্নিত সীমান্তরেখা তৈরি হয়নি। লাদাখের দক্ষিণে হিমাচল প্রদেশ, তার দক্ষিণ-পূর্বে উত্তরাখণ্ড অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতে সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশও চিন সীমান্তে অবস্থিত। সেই সব এলাকাতেও কোনও সীমান্তরেখা চিহ্নিত করা নেই।

আরও পড়ুন: এলএসি’তে সংঘর্ষ, চিনের পাঁচ সেনা খতম, শহিদ তিন ভারতীয় সেনাও

আরও পড়ুন: ৪৫ বছর আগে শেষ বার গুলি চলেছিল ভারত-চিনের মধ্যে, সাক্ষী অরুণাচলের মাগো

কেন চিহ্নিত নেই সীমান্তরেখা? কারণ সীমান্ত সম্পর্কে ভারত এবং চিনের বক্তব্যে গোড়া থেকেই ফারাক ছিল। ভারত যেটাকে সীমান্ত বলে মানে, চিন তা মানে না। আবার চিন যত দূর পর্যন্ত এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে, ভারত তা নস্যাৎ করে দেয়। অতএব লাদাখে হোক বা অরুণাচলে, উত্তরাখণ্ডে হোক বা সিকিমে— কোথাওই স্থায়ী ভাবে চিহ্নিত সীমান্ত নেই। কোথাও সারিবদ্ধ ভাবে পাথর রেখে অস্থায়ী ভাবে সীমান্ত চিহ্নিত করে রাখা হয়। কোথাও আবার সেই পাথুরে সীমানাও নেই। যে এলাকা পর্যন্ত নিজেদের ভূখণ্ড বলে ভারতীয় বাহিনী মনে করে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই পর্যন্ত টহলদারি চালিয়ে আসে ভারতীয় বাহিনী। পরে আবার চিনা সেনাও নিজেদের ইচ্ছামতো টহলদারি চালিয়ে ফিরে যায়।

অর্থাৎ ধারণায় ফারাক। সীমান্ত সম্পর্কে দিল্লি এবং বেজিঙের ধারণা আলাদা এবং সেখান থেকেই সঙ্ঘাত। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধারণায় ফারাক থাকার কথা নয়। কত দূর পর্যন্ত ভারতের এলাকা, সে সম্পর্কে ভারত আগে যা বলত, এখনও তাই বলে। কিন্তু চিন মাঝেমধ্যেই এক একটা এলাকায় এক এক রকম দাবি করতে থাকে বলে তাঁদের অভিযোগ। সীমান্ত সম্পর্কে চিনের দাবিতে কোনও ধারাবাহিকতা নেই বলে প্রাক্তন সেনাকর্তাদেরও অভিযোগ। চিন যে সব দাবি করে, তার পক্ষে কোনও ঐতিহাসিক দলিল তারা তুলে ধরতে পারে না বলে তাঁদের মত। বিভিন্ন এলাকায় সীমান্ত সম্পর্কে চিনের নানা বক্তব্য ভৌগোলিক ভাবেও অবান্তর বলে সেনাকর্তাদের মত।

আরও পড়ুন: ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি খারাপ হবে, হুঁশিয়ারি চিনের

যার দাবি যা-ই হোক, ভারত ও চিনের সীমান্ত তথা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) আসলে কোনটা, তা চিহ্নিত হয়নি আজও। চিহ্নিত হয়নি বলেই সঙ্ঘাতের অবকাশও থেকে গিয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চিন, সীমান্ত স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত নয় বলে বার বার তা লঙ্ঘন করে সঙ্ঘাত তৈরি করছে চিনা বাহিনী। সীমান্তে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে ভারতকে চাপে রাখাই চিনের লক্ষ্য বলে তাঁদের দাবি। তবে যত দিন না সীমান্ত স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এই রকম সঙ্ঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের মত।

India China Ladakh LAC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy