বছর ১৬-র কিশোরী সারা দিন বন্দি থাকত একটা ছোট্ট ঘরে। দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট। সূর্য যত পশ্চিমে ঢলত, আতঙ্কে বিছানার কোনায় ততই সিঁটিয়ে যেত মেয়েটা। সে জানত সন্ধে নামলেই বাইরের তালাটা খুলে যাবে। ঘরে ঢুকবে আইএস যোদ্ধা। একটা ওষুধ খাইয়ে দেবে জোর করে। তার পর শুরু হবে ধর্ষণ।
শুধু ওই কিশোরী নয়, ইরাক এবং সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় শ’য়ে শ’য়ে ইয়াজিদি তরণীকে এই ভাবে যৌনদাসী করে রেখেছে আইএস। কারও বয়স ১৬, কেউ ১৮, কেউ ২০, ২১, ২২, ২৩। রোজ তাদের গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়ানো হচ্ছে। আর তার পর কন্ডোম ছাড়া যৌন সঙ্গমে বাধ্য করা হচ্ছে। ইসলামিক স্টেট ইরাক এবং সিরিয়ার যে অংশ দখল করেছে, সেখানে এই যৌনদাসী প্রথার রমরমা এখন।
ইরাক এবং সিরিয়ার সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়েদেরই মূলত যৌনদাসী বানিয়েছে আইএস। যৌনদাসী কাকে বানানো যাবে, তা নিয়ে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যাঁকে যৌনদাসী বানানো হচ্ছে, তাঁর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার আগে পুরুষকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে সেই নারী গর্ভবতী নন। এই নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য গর্ভনিরোধক ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের বেপরোয়া ব্যবহার শুরু করেছে আইএস। জঙ্গি শিবির থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছে যে ইয়াজিদি মেয়েরা, তাঁদের সাক্ষাৎকারে সামনে এসেছে এই তথ্য। মুক্তি পাওয়ার পর ইয়াজাদি নেতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে এই মেয়েদের। তাঁদের উপযুক্ত চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে সংস্থাগুলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমেরিকা এবং জার্মানিতে আশ্রয় নিচ্ছেন ভয়ঙ্কর যৌন দাসত্বের কবল থেকে বেরিয়ে আসা ইয়াদিজি তরুণীরা।
ইয়াজিদি মেয়েদের কেনাবেচা আইএস শাসিত এলাকায় এখন বেশ বড়সড় ব্যবসা। যে ইয়াদিজি তরুণীরা আইএস ডেরা থেকে পালাতে পেরেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, একাধিক বার হাতবদল হয়েছে তাঁদের ‘মালিকানা’। অর্থাৎ এক আইএস যোদ্ধা বেশ কিছু দিন ধরে ধর্ষণ করার পর যখন কোনও তরুণীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তখন সে তাঁকে বেচে দেয় অন্য কারও কাছে। এই হাতবদল চলতে থাকে কয়েক মাস অন্তরই। আর যে কোনও নতুন মালিক তার যৌনদাসীর হাতে প্রথমেই যেটি দেয়, তা হল একটি গোল বাক্স। সেই বাক্সে ভরা থাকে গর্ভনিরোধক বড়ি। এক মাসের বড়ি এক সঙ্গে। রোজ সন্ধেবেলা ধর্ষণ শুরুর আগে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যৌনদাসীকে ওই বড়ি খেতে বাধ্য করে আইএস যোদ্ধারা। ওষুধ খাওয়ার পর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন।
শুধু গর্ভনিরোধক বড়িতেই কিন্তু শেষ নয়। প্রতি মাসে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়, ইয়াজিদি তরুণী গর্ভবতী হয়ে পড়েছে কি না। যৌনদাসী বেচে দেওয়ার সময়ও এই পরীক্ষা করানো হয়। ক্রেতা নিশ্চিত হয়ে নেয়, যাঁকে সে কিনছে, তিনি গর্ভবতী নন। নাম প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার কাছে ভয়ঙ্কর দিনগুলোর স্মৃতি খুলে বলেছেন আইএস ডেরা থেকে পালিয়ে আসতে পারা অনেক মেয়েই। তাঁদেরই এক জন জানিয়েছেন, কেনার আগে এক আইএস নেতা তাঁকে জি়জ্ঞাসা করেন, কবে তাঁর ঋতুস্রাব হয়েছিল শেষ বার। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সেই নেতা তাঁকে এমন ওষুধ খাইয়েছিল যে ওই তরুণী প্রবল রক্তপাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু সুস্থ হওয়ার পরই এক সন্ধ্যায় সেই আইএস নেতা ওই তরুণীর ঘরে ঢুকে তাঁকে বিবস্ত্র হতে নির্দেশ দেয়। তার পর তরুণীর উরুতে সে গর্ভনিরোধক ইঞ্জেকশন দেয়। ১৫০ মিলিলিটার তরল সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই বিছিনায় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় তরুণীকে। শুরু হয় ধর্ষণ।
আরও পড়ুন:
জঙ্গিদের ‘নাপসন্দ’ হতে গায়ে আগুন কিশোরীর
১৮ বছরের এক তরুণী প্রথমে উত্তর ইরাকের তাল আফার শহরের আইএস গভর্নরের যৌনদাসী ছিলেন। তাঁকে গর্ভনিরোধক বড়িও খাওয়ানো হত। ইঞ্জেকশনও দেওয়া হত। পরে সেই গভর্নর এক কম বয়সি যোদ্ধার কাছে বেচে দেই সেই তরুণীকে। সেই যোদ্ধার মা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষা করানোর জন্য। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে মা তার ছেলেকে জানিয়েছিল, ইয়াজিদি তরুণীটি গর্ভবতী নয়। অর্থাৎ মা ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই তরুণীকে ধর্ষণ করতে কোনও বাধা নেই।
হাসপাতালে প্রত্যেক মাসে মূত্রের নমূনা পরীক্ষা করতে যাওয়ার দিনগুলোকে স্মরণ করছিলেন কেউ কেউ। বলছিলেন, কি নিদারুণ দ্বিধা নিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করতেন রিপোর্টের। রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার অর্থ, তাঁর গর্ভে তাঁর ধর্ষকের সন্তান। রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার অর্থ, আবার রোজ সন্ধে নামলেই ধর্ষিতা হতে হবে তাঁকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy