E-Paper

সাংবাদিকতা ‘সব চেয়ে বিপজ্জনক পেশা’ বর্মা মুলুকে

‘ভুল খবর ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করা’-র দায়ে সন্ত্রাস-বিরোধী ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল মেয়াতকে। দেহ মেলার পরে দেখা গেল গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার আগে ভয়ানক নির্যাতন চালানো হয়েছে মেয়াতের উপরে।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪ ০৬:০৮
জঙ্গলের বাঙ্কারে বিপদ এড়িয়ে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ। ইনসেটে সোয়ে মিন্ট।

জঙ্গলের বাঙ্কারে বিপদ এড়িয়ে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ। ইনসেটে সোয়ে মিন্ট। —নিজস্ব চিত্র।

চলতি ফেব্রুয়ারিতে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের একটা বড় অংশ দখলের পরে মায়ানমার সেনাবাহিনীর ছেড়ে যাওয়া বিমান ঘাঁটির অদূরে গণকবর আবিষ্কার করে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। সেই কবরে আটটি দেহের মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে নজরকাড়া সাংবাদিকতা করা রাখাইনের বাসিন্দা মেয়াত থু তুন-এর। পাঁচ মাস আগে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনী। রাখা হয়েছিল জেলে। ‘ভুল খবর ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করা’-র দায়ে সন্ত্রাস-বিরোধী ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল মেয়াতকে। দেহ মেলার পরে দেখা গেল গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার আগে ভয়ানক নির্যাতন চালানো হয়েছে মেয়াতের উপরে। কেটে নেওয়া হয়েছিল হাত ও পায়ের প্রতিটি আঙুল।

মেয়াতের আগে গুলিবিদ্ধ দেহ পাওয়া গিয়েছে সংবাদচিত্রী আয়ে কাও এবং সোয়ে নাইং-এর। অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের বিক্ষোভ এবং তা দমনে সেনাদের নির্বিচার গুলিচালনার ছবি তুলে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁদের অপরাধ। ফেডেরাল নিউজ়-এর সম্পাদক সাই উইন আউং এবং খনুমতাং সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক পু তুইদিমকে অবশ্য আটক করেনি সেনারা। কর্তব্যরত অবস্থাতেই মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করে দিয়েছে।

সাংবাদিক অধিকার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ২০২৩-এর বাৎসরিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সাংবাদিকতা সব চেয়ে বিপজ্জনক পেশা মায়ানমারে। রিপোর্টটি জানাচ্ছে, চিন ছাড়া দুনিয়ার আর কোনও দেশে এত বেশি সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে ভরে রাখা হয়নি। সেনাদের পাঠানো ইস্তাহার ছাড়া অন্য খবর প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, এমন সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের অনুমোদন ও লাইসেন্স বাতিল করেছে সামরিক জুন্টা সরকার। একের পর এক টিভি চ্যানেলের দফতরে অভিযান চালিয়ে সাংবাদিকদের ঢালাও গ্রেফতার করে সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সংস্থাগুলির হাতে বাছাই করা ১২০০টি ইউপি অ্যাড্রেস ধরি্য়ে দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বাকি সব ব্লক করে দিতে হবে। যেখানে সেখানে, যত্রতত্র ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া তো রয়েছেই। অথচ দেশের সাড়ে ৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩.৮ কোটি মানুষই নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মায়ানমারে।

মিজ়িমা সংবাদগোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক সোয়ে মিন্ট বলছেন, “সংবাদ সংগ্রহ থেকে সংবাদ মাধ্যমের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ, কয়েক বছর ধরে পুরোটাই আমাদের করতে হচ্ছে আত্মগোপন করে, গেরিলা কায়দায়। ইন্টারনেট ও সমাজমাধ্যমই মায়ানমারের মিডিয়ার এখন ভরসা।” সোয়ের প্রতিষ্ঠানের চার জন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের ‘অপরাধে’ ধরা পড়ে কারাবন্দি। মিজ়িমা টিভি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাকে সেনারা তুলে নিয়ে যাওযার পর থেকে আর কোনও খবর মেলেনি। মায়ানমারে এমন গুম হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কয়েকশো।

সোয়ে জানালেন, আপাতত তিন রকমের জায়গা থেকে মায়ানমারের সংবাদমাধ্যমগুলি কাজ করছে। গভীর ও প্রত্যন্ত জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অস্থায়ী দফতর তৈরি করে এবং পড়শি কিছু দেশ থেকে। ভারতের সহযোগিতায় সম্প্রতি দিল্লি অফিস চালু করেছে মিজ়িমা। এই কাজে সোয়ের পুরনো যোগাযোগ কাজে লেগেছে। ১৯৯০-এর ১০ নভেম্বর বিমান ছিনতাই করে কলকাতায় নামানোর পরে ১৩ বছর সোয়ে দিল্লিতে ছিলেন। সনিয়া গান্ধী তাঁর সঙ্গে কথা বলে উৎসাহ দিয়েছিলেন। নিয়মিত খবর রাখতেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল, প্রকাশ কারাট, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তরা। সোয়ে ও তাঁর সহপাঠী টিন চ-র হয়ে আইনি লড়াই করেন প্রখ্যাত আইনবিদ পি এন হাকসারের কন্যা নন্দিতা হাকসার।

২০২১-এর ১ ফেব্রুয়ারি মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। তার কয়েক মাস পরেই ক্যানসার ধরা পড়ে সোয়ের। মিজ়িমা তখন নিষিদ্ধ করেছে জুন্টা। টিভির দফতরে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। গ্রেফতারি এড়িয়ে কখনও নগরে, কখনও জঙ্গলে আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছেন সোয়ে ও তাঁর সহকর্মীরা। তার মধ্যেই ন্যূনতম বন্দোবস্তটুকু করে দফায় দফায় কেমোথেরাপি চলেছে তাঁর। কখনও সময় পেরিয়ে গেলেও ওষুধ মেলেনি, কেমো দিতে দেরি হয়েছে। আপাতত ক্যানসারমুক্ত সোয়ে। জঙ্গল থেকে ইন্টারনেট ফোনে বললেন, “মরারও তো ফুরসত চাই! একটা দিনও মিজ়িমা বন্ধ হতে দিইনি। বহু মানুষ যে আমাদের পথ চেয়ে থাকেন!” ( চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Myanmar Journalism Journalists Life Threat

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy