Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আতঙ্কে রাস্তায় রাত জাগছে নেপাল

আবার কখন শহরটা কাঁপতে শুরু করে! আতঙ্কে তাই কাল সারা রাত রাস্তায় কাটিয়েছে কাঠমান্ডু। গান গেয়ে, প্রার্থনা করে সারাটা রাত কেটেছে সকলের। আর্তি একটাই। ফের যেন সেই হাড় হিম করা কাঁপুনিটা ফিরে না আসে। কিন্তু আজ সকালে সেই আশঙ্কাটাই সত্যি হল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আজ ফের কেঁপে উঠেছে নেপালের একটা বড় অংশ। কালকের ধাক্কা সামলে যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে নেপাল, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে যখন বার করে আনা হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ, ঠিক তখনই আর একটা ধাক্কা। কালকের মতো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও মনোবল ভাঙার পক্ষে এইটুকুই বোধহয় যথেষ্ট ছিল।

হাসপাতালের বাইরে পড়ে সারি সারি দেহ। তারই মধ্যে থেকে পরিজনকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা। কাঠমান্ডুতে রয়টার্সের ছবি।

হাসপাতালের বাইরে পড়ে সারি সারি দেহ। তারই মধ্যে থেকে পরিজনকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা। কাঠমান্ডুতে রয়টার্সের ছবি।

সংবাদসংস্থা
কাঠমান্ডু শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

আবার কখন শহরটা কাঁপতে শুরু করে! আতঙ্কে তাই কাল সারা রাত রাস্তায় কাটিয়েছে কাঠমান্ডু। গান গেয়ে, প্রার্থনা করে সারাটা রাত কেটেছে সকলের। আর্তি একটাই। ফের যেন সেই হাড় হিম করা কাঁপুনিটা ফিরে না আসে। কিন্তু আজ সকালে সেই আশঙ্কাটাই সত্যি হল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আজ ফের কেঁপে উঠেছে নেপালের একটা বড় অংশ। কালকের ধাক্কা সামলে যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে নেপাল, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে যখন বার করে আনা হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ, ঠিক তখনই আর একটা ধাক্কা। কালকের মতো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও মনোবল ভাঙার পক্ষে এইটুকুই বোধহয় যথেষ্ট ছিল।

আসলে কাল থেকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতেই ভুলে গিয়েছে নেপাল। কাল রাতটা তাই কেউ কাটিয়েছেন তাঁবুর ভিতরে। কেউ বা আবার তাঁবুতে থাকার সাহসটুকুও জোটাতে পারেননি। এই এপ্রিলেও এখন কনকনে ঠান্ডা। তবু খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোটাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন কাঠমান্ডুর বাসিন্দা চন্দ্র লামা। চন্দ্র একা নন। কাঠমান্ডুর বেশির ভাগ বাসিন্দাদের মাথার ছাদ তো কাল সকালের তাণ্ডবেই ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাঁদের তবু বাড়ি-ঘর বলতে কিছু অবশিষ্ট ছিল, কাল রাতে তাঁরাও ফিরতে চাননি বাড়িতে। চন্দ্রদের গ্রামের বাড়ি থেকে খবর এসেছে, ভূমিকম্পে সব ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রাণে বাঁচলেও পরিবারের বাকি সকলকে কী ভাবে খাওয়াবেন, সে চিন্তায় ঘুম উড়ে গিয়েছে তাঁর।

গ্রাম হোক বা শহর। নেপালের খণ্ডচিত্র এখন এটাই। কেউ স্বজনহারার শোকে বিহ্বল। তো কেউ সংসার চালানোর চিন্তায় বিধ্বস্ত। যাঁদের সব গিয়েছে, তাঁবুতে সংসার পাতা ছাড়া আর কোনও গতি নেই তাঁদের। দেশ বিদেশ থেকে সাহায্যের হাত আসছে বটে। কিন্তু সব হারানোদের নতুন বা়ড়ি কবে তৈরি হবে? প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছেই। তাঁবু বা খোলা আকাশই তাই অধিকাংশের নতুন ঠিকানা।

কাঠমান্ডুতে রিকশা চালান দীবেশ গৌতম। কালকের ভূমিকম্পে নিজে বাঁচলেও শ’খানেক লোককে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন। কাল থেকে নিজের রিকশায় কমপক্ষে ৪০ জনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন দীবেশ। আর মনে মনে একটাই প্রার্থনা করেছেন, আর কোনও প্রাণ যেন না যায়।

কিন্তু কাঠমান্ডুর হাসপাতালগুলো যে অন্য কথা বলছে। ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের একটা অন্ধকার ঘরে স্তূপিকৃত লাশের সারি। দরজার সামনে বসে রয়েছেন এক সদ্য বিধবা তরুণী। বছর তিরিশের সেই তরুণী অপেক্ষা করছেন স্বামীর দেহ পাওয়ার জন্য। নিজের মনেই বলে চলেছেন, ‘‘ঈশ্বর আমার সঙ্গে এটা কেন করলেন। ওকে একা তুলে নিলেন, আমি কী দোষ করেছিলাম। এ বার আমার কী হবে।’’ কাঠমান্ডুরই বির হাসপাতালে কাল সারা দিনে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো আহতকে আনা হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগকেই বাঁচানো যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবু রোগী আসার বিরাম নেই। কোনও কোনও হাসপাতালের তো পার্কিং লটেও বিছানা পেতে ওটি বানানো হয়েছে। এমন অনেক রোগী হাসপাতালে আসছেন, যাঁদের আত্মীয় বলতে আর হয়তো কেউ বেঁচেই নেই। হাসপাতালের ডাক্তাররাই এখন তাঁদের নিকটাত্মীয়ের কাজ করছেন।

এত মৃত্যু আর ধ্বংসের ছবির মধ্যেও কাল থেকে অনেক মানবিক মুখ দেখেছে কাঠমান্ডু। তার মধ্যে একটা যদি রিকশা চালক দীবেশের মুখ হয়। অন্য দিকে রয়েছে হাসপাতালগুলির অজস্র ডাক্তার আর নার্সেরা। অন্নপূর্ণা নিউরোলজিক্যাল হাসপাতালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করছেন সমীর আচার্য। নিজেই জানালেন কাল থেকে আর ঘুমোনোর সুযোগ পাননি। একের পর এক আহতকে নিয়ে আসা হচ্ছে হাসপাতালে। আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন তিনি ও তাঁর টিমের অন্য ডাক্তাররা। ঘুম নিয়ে যদিও কোনও অভিযোগ নেই সমীরের। জানালেন, কাল থেকে যারা হাসপাতালে এসেছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। আর এটাও বলতে ভুললেন না, ‘‘ঘুম হয়নি জানি। শরীরটা আর চালাতে পারছি না। কিন্তু উপায় নেই। আহতদের যে অবস্থায় আনা হচ্ছে, ওঁদের ফেরাবো কোন মুখে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE