Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Mountain

‘বারবার বার্তা পাঠাচ্ছিলাম, কেউ সাহায্য করতে এল না, চোখের সামনে মারা গেল কুন্তল’

যে সংস্থা বিপ্লবদের নিয়ে গিয়েছিল, সেই ‘পিক প্রোমোশন’-এর দিকেও প্রকারান্তরে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

বারবার বার্তা পাঠিয়েও কোনও সাহায্য পাননি নেপালি পর্বতারোহী নির্মল পুর্জা। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

বারবার বার্তা পাঠিয়েও কোনও সাহায্য পাননি নেপালি পর্বতারোহী নির্মল পুর্জা। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কাঠমাণ্ডু শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ১৪:৩৩
Share: Save:

এখনও কাঞ্জনজঙ্ঘায় চার নম্বর ক্যাম্পের উপরে তুষারশয্যায় শায়িত বাঙালি পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্য। তাঁদের মৃতদেহ নামিয়ে আনার অভিযান শুরু করতে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কাঠমাণ্ডুতে পৌঁছেছে বাঙালি পর্বতারোহীদের একটি প্রতিনিধিদল। অন্য দিকে তুষারক্ষতে আক্রান্ত রুদ্রপ্রসাদ হালদার এবং রমেশ রায়কে নিয়ে আসা হয়েছে কাঠমাণ্ডু হাসপাতালের নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হল বিপ্লব এবং কুন্তলকে?

তাঁদের উদ্ধারের একটা মরণপণ চেষ্টা কিন্তু চালিয়েছিলেন নির্মল পুর্জা নামের আরেক অভিযাত্রী। নীচে নেমে এসে সেদিনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন নির্মল। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সেদিন কাঞ্জনজঙ্ঘায় বিভিন্ন অভিযাত্রী দলের অন্তত ৫০ জন ছিলেন। কেউ একটু সাহায্য করলে কুন্তল-বিপ্লবকে হয়তো বাঁচানো যেত।’’

১৫ মে, অর্থাৎবুধবার সকালেই ক্যাম্প ফোর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা শিখরের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছিল বাঙালি অভিযাত্রী দলটি। ক্যাম্প ফোর আর সামিটের মধ্যেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় অন্য আরেকটি অভিযাত্রী দলের দুই পর্বতারোহী মিংমা ডেভিড শেরপা এবং নির্মল পুর্জার। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন গাইড গেশমান তামাং এবং দাওয়া শেরপা। ১৪ মে দুপুর ১১টার সময় তাঁরা কাঞ্জনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছন। সেদিন রাত ১টাতেই তাঁরা সরাসরি কাঞ্জনজঙ্ঘা শিখরের উদ্দেশে রওনা দেন। একের পর এক ক্যাম্প পেরিয়ে টানা দশ ঘণ্টা ‘ক্লাইম্ব’ করার পর সকাল ১১টা ১৯ মিনিটে তাঁরা পৌঁছে যান কাঞ্জনজঙ্ঘা শিখরে। সেখান থেকে নামার সময়েই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় কুন্তল আর বিপ্লবের।

কাঠমাণ্ডুর হাসপাতালে রুদ্রপ্রসাদ হালদার এবং রমেশ রায়। ছবি: পিক প্রোমোশনের সৌজন্যে পাওয়া।

নির্মলের কথায়, ‘‘শিখর থেকে নামার সময় ৮,৪৫০ মিটার উচ্চতায় আমি ভারতীয় পর্বতারোহী বিপ্লব আর ওঁর গাইডকে দেখতে পাই। ওঁদের দু’জনেরই অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওঁদের তখনই উদ্ধার করার প্রয়োজন ছিল। আমাদের অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে শুরু করে দিই উদ্ধার অভিযান। একই সঙ্গে ক্যাম্প ফোরে অক্সিজেন আর উদ্ধারকারী দল পাঠানোর বার্তা পাঠাই।’’

অসুস্থ বিপ্লবকে নিয়ে ১৫০ মিটার নামার পর কুন্তল কাঁড়ারের সঙ্গে দেখা হয় নির্মল আর তাঁর সঙ্গে থাকা দলের। কিন্তু কুন্তলকে ছেড়ে সবাই চলে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন নির্মল। তাঁর দাবি, ‘‘কুন্তলের সঙ্গে ওঁর গাইডও ছিল না। ও খুবই অসুস্থ অবস্থায় একদম একা ছিল। এঁদের সবাইকেই নিয়ে গিয়েছিল ‘পিক প্রোমোশন’ নামের একটি সংস্থা। আমি কুন্তলকে আমার নিজের অক্সিজেন দিয়ে দিই। ফের শুরু করি উদ্ধার অভিযান। কিন্তু কয়েক মিটার নামার পর আমার গাইড গেশমানও ওঁর অক্সিজেন দিয়ে দেয় বিপ্লবকে। দুপুর আড়াইটের সময় আমাদের দলের কাছে কোনও অক্সিজেন ছিল না। সবই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিপ্লব আর কুন্তলকে।’’

আরও পড়ুন: ‘ছেলের মৃত্যুর জন্য আমিও তো দায়ী’

৮,৪০০ মিটার উচ্চতায় নিজেদের জীবন্ন বিপন্ন করে উদ্ধারকার্য চালানোর পাশাপাশি প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর নিচের ক্যাম্পে রেডিয়ো বার্তা পাঠাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন নির্মল। প্রতি বারই বলা হচ্ছিল নীচ থেকে তিন জনের শেরপার একটি দল তাঁদের সাহায্য করতে পাঠানো হচ্ছে। সেই ভরসাতেই তাঁরা নিজেদের অক্সিজেন বিপ্লব আর কুন্তলকে দিয়ে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন নির্মল। কিন্তু কোনও সাহায্য না আসাতে সবার জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছিল। কারণ ৮,০০০ মিটারের উচ্চতায় অক্সিজেন ছাড়া বেশিক্ষণ কাটানো মানেই নিশ্চিত মৃত্যু, এমনটাই নিয়ম পর্বতারোহণের।

এর পরই ঘটে দুর্ঘটনা। নির্মলের কথায়, ‘‘আমি বুঝতে পারি অক্সিজেন ছাড়া থাকার জন্য আমার গাইড গেশম্যান উচ্চতা জনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ও জমে যাচ্ছিল। তাই ওঁকে আমি অপেক্ষা না করে নীচে নেমে যেতে বলি। এই সময়ই চোখের সামনে মারা গেল কুন্তল। একটু অতিরিক্ত অক্সিজেন ছিল না কারও কাছে।’’

বুধবার সকাল ৫.৪৩ মিনিটে এই অবস্থানে ছিলেন বিপ্লব। তথ্য: স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং করে পাওয়া।

বাধ্য হয়ে কুন্তলকে ওখানে রেখেই অসুস্থ বিপ্লবকে নিয়ে নীচে নামতে শুরু করেন নির্মল। দুপুর গড়ালেই পাহাড় হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কুল। এই সময় থেকে ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই কারণে বিপদ আরও বাড়ছিল। নির্মল বলছেন, ‘‘আমার দেখা সব থেকে শক্তিশালী শেরপা মিংমাও অতি উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে এই সময়। ওঁকে নিয়ে নীচে নামার জন্যও কোনও সাহায্য এল না। ওঁকে নিয়ে আমার উদ্বেগ ছিল। আরও একটা মৃত্যু আসুক, তা কোনও ভাবেই চাইছিলাম না। এর পরই দাওয়া আর আমি মিলে ওঁকে নিয়ে নীচে নামতে থাকি। তখন আমাদের কাছে এক ফোঁটা অক্সিজেন নেই।’’

আরও পড়ুন: কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশয্যায় চিরঘুমে কুন্তল আর বিপ্লব

নিজের দলকে নিয়ে নিরাপদে নিচে ফিরে এলেও কেন ৫০ জন পর্বতারোহী থাকলেও কেউ একটু সাহায্যের হাত বাড়ালো না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। যে সংস্থা বিপ্লবদের নিয়ে গিয়েছিল, সেই ‘পিক প্রোমোশন’-এর দিকেও প্রকারান্তরে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

পর্বতারোহণ সব সময়েই বিপদসঙ্কুল, দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে সব সময়েই। কিন্তু কোথাও কি প্রস্তুতির কোনও সমস্যা থাকছে। বিপ্লব বৈদ্যর সঙ্গেই নর্থ কল দিয়ে মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেছিলেন আরেক বাঙালি পর্বতারোহী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের শৃঙ্গ জয়ের অভিযানের খরচ প্রচুর। আমাদের বাঙালিদের সেই আর্থিক সংস্থান করতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। তার পরেও সমঝোতা করতে হয় আরও অনেক কিছুর সঙ্গে। সেটা একটা বড় কারণ হয়ে যায় কোনও বিপদ হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে। এ ছাড়া ক্যাম্প ফোর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃ্ঙ্গে যেতে প্রায় হাজার মিটারেরও বেশি উঠতে হয়। শৃ্ঙ্গ জয়ের শেষ দিনে একসঙ্গে এতটা উচ্চতা ওঠা এবং নেমে আসা কষ্টসাধ্য। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিকের থেকে অনেক অনেক কম। আর এভারেস্টের থেকে পর্বতারোহণের মাপকাঠিতে অনেক বেশি কঠিন কাঞ্চনজঙ্ঘা। তাই বিপদের আশঙ্কা থাকেই।’’ একই সঙ্গে এই ধরনের অভিযানের আগে শারীরিক ভাবে বাঙালি পর্বতারোহীদের আরও প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন দেবব্রত।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mountain Climbing Mountaineering Kanchenjunga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE