E-Paper

আতঙ্কের রাত নামছে পোড়া শহরে

কার্ফুর শাসনে থাকা এই শহর কয়েক পাক মারলে কিন্ত এই গন্ধটাকে আর সন্দেহজনক লাগবে না আপনার। কারণ কাঠমান্ডুকে দেখাচ্ছেই তো সদ্য নেভা অঙ্গারের মতো।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৩২
জারি রয়েছে কার্ফু। পার্লামেন্টে পৌঁছনোর পথ আগলে সেনা। বৃহস্পতিবার, কাঠমান্ডুতে।

জারি রয়েছে কার্ফু। পার্লামেন্টে পৌঁছনোর পথ আগলে সেনা। বৃহস্পতিবার, কাঠমান্ডুতে। ছবি পিটিআই।

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখার মিনিট কয়েকের মধ্যে ধাতস্থ হওয়ার জন্য যেটুকু সময়। তার পরই যে গন্ধটা এসে ধাক্কা মারল, সেটা নিতান্তই পরিচিত। কারণ এই গন্ধ পাওয়া যায় শ্মশানে!

কার্ফুর শাসনে থাকা এই শহর কয়েক পাক মারলে কিন্ত এই গন্ধটাকে আর সন্দেহজনক লাগবে না আপনার। কারণ কাঠমান্ডুকে দেখাচ্ছেই তো সদ্য নেভা অঙ্গারের মতো। কুয়াশার ঋতু আসতে ঢের দেরি। তার আগেই আতঙ্কের অনন্ত চাদরে মুড়েছে নেপালের রাজধানী। খবরে প্রকাশ, আতঙ্ক ডালপালা মেলেছে কাঠমান্ডুর বাইরেও, পোখরা ও অন্যত্র। এখানের বাতাস আগামিকালের আশঙ্কা বহন করছে এখনও।

আসলে দুঃস্বপ্নের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে গত তিন দিনে। যার জেরে রাজপথের যত্রতত্র উল্টে রয়েছে গাড়ির ঝামা হওয়া কঙ্কাল। আপনার মনে হবে, কাঠমান্ডুর ডাকনাম এখন আতঙ্ক। এই শহরের রং এখন জলপাই। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। বিকেল পাঁচটায় কার্ফু উঠে যাওয়ার পরের ছবি কিছুটা আলাদা। আলাদা, কিন্তু স্নায়ুকে অসাড় করে দেওয়ার মতো। কারণ পাঁচটার পরে শুরু হতে দেখলাম ধ্বংসের একক ও অনন্য এক প্রদর্শনী। যার মধ্যে বিশেষ করে চোখে লাগল নেপালের পার্লামেন্টের মূল ফটক থেকে শুরু করে ভাঙচুর দেওয়ালের দৈর্ঘ্য বরাবর ভিড়। বাচ্চা কোলেও পুরুষ-নারী আসছেন, সেল্‌ফি তুলছেন পিছনে ধ্বংসকে রেখে। সেনা এসে সরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত। না, এঁরা কেউ জেন জ়ি নন, নেহাতই মজা দেখতে এসেছেন না পরিবর্তনের আঁচ পেতে, তা বোঝা দায়। একই চিত্র ভাঙচুর হওয়া সুপ্রিম কোর্টের সামনেও।

এসে দাঁড়িয়েছি হিংসার গ্রাউন্ড জ়িরো অর্থাৎ আজই আগুন নেভানো বহুতল হিলটন হোটেলের সামনে। যার অর্ধেক অবিকল এক, বাকিটা ঝলসে গিয়েছে। সামনের রাস্তাটাও তথৈবচ। বাইরের দিকের ইমার্জেন্সি ঘোরানো সিঁড়িটা কোন নরকে উঠে গিয়েছিল গত কাল? আশপাশ দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে অ্যাম্বুল্যান্স, আর ওই হোটেলের শূন্যতার ভিতর অবিরল জল পড়ার শব্দ। এখন ভিতরে হয়তো আগুন থামানোর কাজ চলছে। হোটেলের উল্টোদিকেই ভগবতী ভালের মন্দির। সামনে স্থানীয় মানুষের ছোট্ট জটলা। ভারত থেকে এসেছি শুনে প্রসন্ন হলেন, না তার ঠিক উল্টোটা— তা বোঝা গেল না! কারণ অদূরেই কার্যত মার্চ পাস্ট করছেসশস্ত্র সেনাবাহিনী।

এই ছোট ছোট জটলাগুলি, বয়স নির্বিশেষে এখানকার ফুটপাতে, মোড়ে, মহল্লায় কার্ফু ওঠার পর। কিন্তু কোথাও মিছিল নেই, জেন জ়ি-র রুদ্রমূর্তি নেই অন্তত আজ। কারণ? হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন থামেলে ইয়েতি ট্রেকিং সংস্থার ছোট্ট দোকানের এক কর্মী রাজ শাহ বাবু— ‘‘আমরা যা করার করে দিয়েছি। আর কোনও ঝামেলা দেখবেন না রাস্তায়। পরিবর্তন আনার ছিল, এনে দিয়েছি। আমাদের দিন গুজরান দায় হয়ে উঠেছিল রাজনীতির নেতাদের দুর্নীতিতে। সেই ২০০৮ সাল থেকে চলছে সার্কাস। দিয়েছি সব খতম করে।’’ কথার শুরুতে যে হাসিটা ছিল, বাক্যের শেষে এসে তা উধাও, শক্ত চোয়াল।

কিন্তু এই ভাষ্য এক রকমের। আরও দু’রকম কথাও বলেছেন কাঠমান্ডুর পথচারী। পার্লামেন্টের সামনেই ধরা গেল কুপান্দুল এলাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিসের নিরাপত্তাকর্মী প্রকাশ মৈনালিকে। একটি বেসরকারি সংস্থা ভারু গরুড় সিকিয়োরিটি তাঁকে ওই অফিসে নিয়োগ করেছে। সপ্তাহে সাত দিন কাজ, ছুটি নেই, বেতন নেপালি টাকায় মাসে কুড়ি হাজার। এই অসম্ভব শ্রমের চাপে তিনিও সরকার-বিমুখ। তবুও বলছেন, ‘‘আমরা সুশাসন চাইছি, সরকারের দুর্নীতি আর নেওয়া যাচ্ছে না। আমিও জুলুসে (জমায়েতে) ছিলাম। কিন্তু ওই দিন বেলা ১১টার পর থেকে সব হাতের বাইরে চলে গেল যেন। বাইরে থেকে হুড়মুড় করে লোক ঢুকে পড়ল। যা হয়েছে, তা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে। এতটা দরকার ছিল না।’’ এটি হল দ্বিতীয় ভাষ্য। তৃতীয় ভাষ্যটি যাঁদের, তাঁরা গোটা দিন কর্মনাশা ভাবে ঘরে আটকে থাকার পরে শাপশাপান্ত করছেন গোটা অভ্যুত্থানকে। সঙ্গে বলছেন, জান-মালের বড়ই ক্ষতিহয়ে গেল।

এখানকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম কান্তিপুর টেলিভিশনের সামনে ম্লান অথচ সতর্ক ভাবে বসে রয়েছেন কতিপয় সাংবাদিক। যেন দুর্গ রক্ষা করছেন। ভিতরের গাড়িগুলিও যথারীতি ঝামা। ঝলসে গিয়েছে এই অফিসও। যে কোনও সাংবাদিকের এই দৃশ্য দেখলে বুক না কেঁপে যায় না। তবুও এই ধ্বংসাবশেষ থেকে পুরাণ-পাখির মতো ফিরে আসার প্রতিজ্ঞায়, তাঁরা আগামিকাল ওই পোড়া অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সম্প্রচার শুরু করবেন বলে জানালেন।

সেনার দাপটে রাস্তায় জেন জ়ি-কে দেখা না গেলেও গত কাল থেকে আজ, চব্বিশ ঘণ্টা এই মঞ্চের অধীন বিভিন্ন সংগঠন এবং ‘কন্টেন্ট ক্রিয়েটর’কে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমে। যাঁদের থিম সঙ্গীত, জেন জ়ি-র সদর্থক আন্দোলন হাইজ্যাক করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি এবং লুটপাট করেছে কিছু শ্রেণির সংগঠন ও অপরাধী। ‘হামি নেপাল’, ‘জেন জ়ি নেপাল’, ‘হাউ টু দেশ বিকাশ’-এর মতো বিভিন্ন সংগঠন এই বর্বরতার নিন্দা করে বিবৃতি দিচ্ছে এবং নিজেদের বিযুক্ত করার চেষ্টা করছে। জেন জ়ি একটি বিবৃতি দিয়ে এ কথাও বলেছে, তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের পথেই হাঁটছে। যা ঘটেছে, তার দায় তাদের নয়।

কার দায়, সেই প্রশ্নের সামনে আরও একটা আতঙ্কের রাত নামছে কাঠমান্ডুতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kathmandu Nepal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy