Advertisement
E-Paper

ওবামার কিউবা সফর, এখনই গেল গেল রব তোলার মানে নেই

তখন সাল ১৯৫৯, ফ্লোরিডার ৯০ কিমি দূরে বিপ্লব। বাতিস্তার সরকারকে উল্টে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পূর্ব দিগন্ত লাল করে দেওয়া কিউবা, লাতিন আমেরিকার মানুষের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসে এই প্রথম আমেরিকার উঠোন থেকে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে দাঁড়ালো, আগুন জ্বালিয়ে, নেপথ্যে দাঁড়িয়ে দুটি মানুষ চে গেভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো।

নিশান চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ১৩:৩৮

তখন সাল ১৯৫৯, ফ্লোরিডার ৯০ কিমি দূরে বিপ্লব। বাতিস্তার সরকারকে উল্টে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পূর্ব দিগন্ত লাল করে দেওয়া কিউবা, লাতিন আমেরিকার মানুষের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসে এই প্রথম আমেরিকার উঠোন থেকে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে দাঁড়ালো, আগুন জ্বালিয়ে, নেপথ্যে দাঁড়িয়ে দুটি মানুষ চে গেভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো। চে'কে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার দরকার নেই, সকলেই জানেন।

আর ফিদেল সম্ভবত আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা নেতা। সোভিয়েতের পতনের পর মার্কিন ব্যাঘ্রের থাবার তলায় বসে মানুষগুলি যে নতুন দিগন্তের স্বপ্ন দেখতে পেরেছেন, পেরেছেন উঠে দাঁড়াতে, চূড়ান্ত চাপের সামনেও নতি স্বীকার করেননি, তার পেছনেই বা কে?

সেই ফিদেল। কিউবার এক শিল্পী এসেছিলেন কদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি জানালেন কোনও প্রযুক্তি ছাড়া কী ভাবে কিউবার লোক দাঁড়িয়েছে উঠে। যেমন, যেটা ছিল জলের বোতল সেটা হয়ে দাঁড়ালো তেলের ট্যাঙ্ক। সে লাগলো গিয়ে ভাঙা সাইকেলের গায়ে, সে হয়ে গেলো মোটরবাইক আর গর্বিত কিউবান তাতে চড়ে চলল তার নিজের কাজে। এই যে, যে জিনিসটার আপাতভাবে যেটা হওয়ার কথা নয়, সে সেটা হয়ে মানুষকে এগিয়ে দিলো, অনেকটা এগিয়ে দিল, এটাই কিউবার প্রাণভোমরা। স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ককে অস্বীকার করার দুঃসাহস, প্রযুক্তিগত সম্পর্ককে অস্বীকার করার দুঃসাহস, স-অ-ব, এটাই আসল খাঁটি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, এটাই মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রকৃতির সামনে, অন্য মানুষের সামনে আর দেয় বাঁচার প্রেরণা।

সে যাই হোক, কিউবা এখানে, এই মহা স্বাধীনতায় এল কেন? বা বলা ভাল আসতে বাধ্য হল কেন? কারণ আবার কে? হরি হে দীনবন্ধু তুমি আমারও বন্ধু বাপেরও বন্ধু, আমেরিকা!

আমেরিকা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল অজস্র নিষেধের বোঝা। ছোট্ট কিউবা কিন্তু প্রতিরোধে দৃঢ় মেরুদণ্ডে টিকে থেকে গেছে অনেক দিন। মাঝে ফিদেলের বক্তৃতায় ভিড় উপচে পড়েছে নিউ ইয়র্ক শহরের চার্চে, ঘটে গেছে অনেক কিছু, হাডসন বয়ে গড়িয়েছে অনেক জল।

অবশেষে বারাক ওবামা, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১৪য় এসে তুললেন নানা নিষেধাজ্ঞা।

এরপর তিনি বললেন, তিনি যাবেন! কিউবায়!

এই প্রথম কোনও মার্কিন রাষ্ট্রপতি সমাজতান্ত্রিক কিউবায় গেলেন। ভাবা যায়? আমেরিকায় যায় না, লবিসমৃদ্ধ রাজনীতির বাজারে একেবারেই যায় না। গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না, আর অর্থনীতি গণতন্ত্রের মেশিনারির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত হলে যা হয় আর কী।

জিমি কার্টার গেছিলেন ২০১১'র জুন মাসে, কিন্তু তিনি তখন প্রাক্তন, ওবামা গেলেন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন। এহেন অভাবনীয় ঘটনা কমই ঘটেছে। রিপাবলিকানরা জানাচ্ছেন তিনি বেসবল খেলতে গেছেন, কিউবান জনতা মোটের উপর খুশি, কিন্তু বাংলার বামেদের তেমন হেলদোল নেই।

হয়তো এটাও ভাবার বিষয়, এটা নিয়ে অতিরিক্ত আনন্দেরও কিছু নেই, বিদ্বেষেরও কিছু নেই। ওবামা গেছেন খুবই আনন্দের বিষয়, কিন্তু তিনি করবেনটা কী শেষ পর্যন্ত সেটাও তো ভাবার? ওবামার এটা দ্বিতীয় বারের রাষ্ট্রপতিত্ব, অতএব তাঁর আরেকবার রাষ্ট্রপতিত্বে আসার সুযোগ নেই (সম্ভবতঃ তিনিও সেটা জানেন বলেই যাবার সাহস করলেন), কিন্তু তার মানে তিনি বিশেষ কিছু করেও উঠতে পারবেন না। অতএব ফিদেলকে নিয়ে আনন্দ করা বামেদের ওবামাকে নিয়েও আনন্দ করতে হবে এর মধ্যে বিশেষ কোনো যৌক্তিক সম্বন্ধ নেই। আর যাঁরা এতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের গন্ধ পাচ্ছেন তাঁরা ওবামার ক্ষমতা ও পরিস্থিতি দেখলেই বুঝবেন সে যুক্তি ধোপে টেকে না।

আরও পড়ুন-

কিউবায় সাম্রাজ্যবাদীকে আমন্ত্রণ এবং বঙ্গীয় বামপন্থীগণ

কিন্তু তার পরেও এই মিলন নিয়ে থেকে যায় হাজারটা প্রশ্ন। যেমন, কী হবে তাহলে কিউবার? কিউবাও কি চিনের মতোই হাঁটবে বাজারের পথে, চে গেভারার ছবির পাশে কি মার্কিন টুরিস্ট গলা ভেজাবেন কোকা কোলার কাপে, আর সেই সেলফিতে ছেয়ে যাবে ফেসবুক? না কি আদতেই কিউবা তার নিজস্বতা বজায় রেখে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রেখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? কিন্তু যা কিছুই কিউবা করতে চাক না কেন, তার গলা টিপে ধরে থাকলে কোনো কিছুই সম্ভব হবে না। সে দিক দিয়ে বারাকের এই যাওয়া আর কিছু না হোক একটা সেতুবন্ধনের সুযোগ হয়তো করে দেবে।

আর আশাবাদী মানুষ যাঁরা তাঁরা ভাবতেই পারেন, কিউবার যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যা ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে, তার হয়তো আরও উন্নতি হবে, কিউবার অর্থনীতি হয়তো আবার জেগে উঠবে, আর তার শক্ত পিঠ দেখে জেগে উঠবে সারা লাতিন আমেরিকা, হয়তো সারা বিশ্ব।

অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে মার্কিন সরকার ও জনতার মধ্যে বিস্তর বিভেদ, না হলে নিউ ইয়র্ক বা অন্যত্র ফিদেলের বক্তৃতায় লোকের ভিড় উপচে পড়তো না। বদলাচ্ছে দৃশ্যপট আমেরিকায়, নিজেকে সোশ্যালিস্ট বলা বার্নি দাঁড়াচ্ছেন ভোটে, ডেমোক্র্যাসি অ্যাট ওয়ার্কের সভায়, লেফট ফোরামে, রিচার্ড উল্ফের বক্তৃতায় লোক বেড়ে চলে। এদেশেও অনেকেই আছেন যাঁরা কিউবার প্রতি সহানুভূতিশীল, পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদের জন্যও দরজাটা খুলে গেলো বই কি।

ফিদেল আর ক্ষমতায় নেই, রাউল রয়েছেন, তারপর আসবেন আরও কেউ, কিন্তু কত দিন আর সম্ভব হবে এই ভাবে শেষ প্রাণবিন্দুটুকু দিয়ে টিকে থাকা? সে দিক দিয়ে ওবামার পদক্ষেপগুলি ইতিবাচক বই কি। কিন্তু শুভাশুভের বিচার এই অর্থনীতিতে দাঁড়িয়ে ভারী দুষ্কর, আর সেই পরিবর্তন আনতে গেলে আনতে হবে মার্কিন দেশেই। কাজেই সেই সময়ের অপেক্ষা ছাড়া বামপন্থার এই মুহূর্তে কিছু করার নেই।

(লেখক সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক-এ অঙ্কের গবেষক)

cuba fidel castro obama
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy