প্রায় এক মাস কেটে গিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস আর তার সংলগ্ন এলাকার দাবানলের। তার পরে হঠাৎ গত কাল প্রবল বর্ষণ ও কাদাধস ঘরহারা মানুষগুলোকে নতুন করে সঙ্কটে ফেলে দিল।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের আইনের ছাত্র আমি। তবে গত মাসে এই দাবানল যখন শুরু হয়, আমি ছিলাম দেশের পূর্ব প্রান্তে, বস্টনে মা-বাবার কাছে। কিন্তু সিমেস্টার শুরু হওয়ার পরে আমি ক্যাম্পাসে ফিরে যাই। চোখ জ্বালা, মুখ মুখোশে ঢেকে রাখা, হাওয়ায় ছাইয়ের কণা— এ সব ছাড়া তেমন ভাবে প্রথম দিকে কিছু বুঝতে পারিনি। তবে বন্ধুদের থেকে দাবানলের ধ্বংসলীলার অনেক গল্প শুনছিলাম।
পরিস্থিতি খানিকটা আয়ত্তের মধ্যে আসার পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা কত বেশি। এখন পর্যন্ত এই দাবানলকে আমেরিকার তথা পৃথিবীর অন্যতম আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিকারক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ক্ষতি ২৫ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
এত দিন ধরে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে গিয়ে গিয়ে জলের লাইন, গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে এবং আরও বিপদের আশঙ্কা হতে পারে কি না খতিয়ে দেখে তারপর বাড়ির মানুষদের অনুমতি দিচ্ছেন এলাকায় ফিরে আসার জন্য। কিন্তু গতকালের প্রবল বৃষ্টি ও তার পরে কাদাধস এই কাজে অনেকটাই ব্যাঘাত ঘটাল।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আইনি পরামর্শদান কেন্দ্রে আমি অংশগ্রহণ করছি। এক ছাদের নীচে এত মানুষ, যাঁরা এত কিছু হারিয়েছেন, আবার অন্য দিকে সরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি এত রকম সাহায্যের বা পরামর্শ নিয়ে হাজির হচ্ছে, সেটা আমার কাছে একটা মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা। সেখানে ফেডারেল এমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট সেন্টার— অর্থাৎ আমেরিকার প্রধান দুর্যোগ ত্রাণসংস্থা যেমন উপস্থিত ছিল, তেমনই ছিল রেড ক্রস, গুড স্যামারিটানের মতো বড় বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তার সঙ্গে বহু সরকারি কর্মী। হোটেলের ভাউচার, খাবার জিনিসের ভাউচার, ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থার মতো বড় বড় জিনিসের ব্যবস্থা তো তাঁরা করছিলেনই। তার সঙ্গেই ছিল বহু খুঁটিনাটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যেমন ধরুন কারও পাসপোর্ট পুড়ে গিয়েছে, নতুন করে তার দরখাস্ত করা, তেমনই জন্মের শংসাপত্র বা বিমার নথি হারিয়ে গেলে তার দরখাস্ত, এ সব করে দেওয়া খুব জরুরি, কারণ প্রাকৃতিক তাণ্ডবের পরে কারওরই গুছিয়ে আবেদন করার মতো মানসিক অবস্থা নেই। এই কাজে সাধারণ মানুষ, বয়স্কদের বেশি সাহায্য দরকার। পুড়ে যাওয়া বাড়িতে কী কী ছিল, তার মূল্য কেমন, সেটা প্রমাণ করা জন্য বাড়ির ভিতটুকু ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেক ক্ষেত্রে একটু একটু করে পুরোনো ছবি, যা সমাজমাধ্যমে আছে, তার থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, একটা পরিবারের সম্পূর্ণ জীবন কী রকম ছিল।
এ ছাড়া, পুলিশ বিভাগ থেকে নিরাপত্তাবিদেরা ছিলেন বলার জন্য এই গন্ডগোলে কী ভাবে মানুষ নানা প্রবঞ্চনার শিকার হতে পারেন। আমি আর আমার বন্ধুরা সাহায্য করার চেষ্টা করেছি এই পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালারা বাড়ির ভাড়া বাড়িয়ে দিলে, বেশি ভাড়ার জন্য মিথ্যাচারণ করলে, অথবা বাড়ি আগুন বা ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাসযোগ্য না থাকলেও তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করার চেষ্টা করলে ভাড়াটেরা কি কি আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন, সে বিষয়ে। এলাকার বেশির ভাগ মানুষই দুর্গতদের নানা ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।।
এ ভাবেই একটু একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের চারপাশের এলাকা। কিন্তু কালকের দুর্যোগ পরিস্থিতি আরও করুণ করে দিল। তবু আশা করি অদূর ভবিষ্যতে ছন্দে ফিরতে পারবেন এলাকার মানুষ।
অনুলিখন: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)