শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্য হল। শিয়া শেখ নিমর আল-নিমর এর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সোমবার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করল সৌদি আরব। এর আগে, রবিবার ইরানের রাজধানী তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা। দূতাবাস লক্ষ করে পেট্রোল বোমা ছোড়ে। যদিও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় সৌদি আরবের কূটনীতিকদের কোনও ক্ষতি হয়নি। এর পরেই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করে সৌদি আরব। ইরানের কূটনীতিকদের দু’দিনের মধ্যে সৌদি আরব ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৮ সালেও ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। ১৯৯১ সালে আবার সম্পর্ক জোড়া লাগে। এ দিন বাহরিনও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করল।
নিমরের মৃত্যুদণ্ডের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। এমনই আশঙ্কা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এই মৃত্যু নিয়ে মধ্য এশিয়ার শিয়া-সুন্নি প্রধান দেশগুলি আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। শিয়া দেশগুলির হয়ে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছে ইরান। নিমরের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরবকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইরান। সৌদি আরবকে এর ফল ভুগতে হবে বলে জানিয়েছিল। এ দিন মুখ খুলেছেন ইরানের মোল্লাতন্ত্রের প্রধান নেতা আয়াতুল্লা আল-খামেইনি। নিমরকে তিনি শহিদের আখ্যা দিয়েছেন। ইরানের অভিযোগ, সৌদি আরব বরাবরই অভ্যন্তীরণ সমস্যাগুলির দায় বাইরের দেশের উপরে চাপিয়ে দেয়। যেমন, নিমরের ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরাক, বাহরিন, ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়ার মতো দেশের শিয়া নেতারা। উল্টো দিকে অবস্থান কড়া করেছে সৌদি আরব। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ সেই অবস্থানের একটি সঙ্কেত। সঙ্গে আছে সুন্নি দেশগুলি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ঘোর বিরোধী সৌদি আরব। সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের সক্রিয় অংশগ্রহণ একেবারেই মেনে নিতে পারেনি সৌদি আরব। আবার ইরানের অভিযোগ, আইএস-এর উত্থানের পিছনে সৌদি আরবের হাত রয়েছে। মধ্য এশিয়া জুড়ে দু’পক্ষের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ লেগেই আছে। দুই মিলিয়েই অনেকটাই যেন ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি। নিমরের মৃত্যু সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
এই ফাঁকে পড়ে মধ্য এশিয়া জুড়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) দমনে পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে আইএস দমন সম্ভব নয়। কারণ, আইএস শুধু জঙ্গি সংগঠন নয়, মতাদর্শও বটে। শিয়া, সুন্নি— দুই সম্প্রদায় পরস্পরের কাছে না এলে আইএস-এর মতাদর্শের মোকাবিলা করা কার্যত অসম্ভব। গত বছরের শেষের দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়া নিয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ করে। সেখানে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মেটাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি আলোচনার প্রস্তাবও ছিল। সেইমতো সৌদি আরব, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের বিরোধী, কিন্তু জঙ্গি মৌলবাদের সঙ্গে জড়িত নয় এমন গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে আলোচনায় বসে। যাতে পরে বাসার আল-আসাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হলে বিরোধীদের তরফ থেকে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব সামনে রাখা যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমনই যে এর পরে সেই উদ্যোগ বেশি দূর এগোবে কি না সন্দেহ।
আর এতে প্রমাদ গুনছে আমেরিকা। পারস্য উপসাগরের দু’দিকের এই দু’টি দেশ বর্তমান মার্কিন বিদেশনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরব দীর্ঘ দিন মধ্য এশিয়ায় আমেরিকার প্রধান বন্ধু। কিন্তু এখন ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির দিকে হাঁটছে ওবামা প্রশাসন। সম্প্রতি পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক সমঝোতা হয়েছে। যে সমঝোতার পিছনে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে দীর্ঘ দিন নির্বাসিত থাকার পরে ধীরে ধীরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল ইরান। যদিও এই সমঝোতা নিয়ে খুশি ছিল না সৌদি আরব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পুরো পরিবেশকেই বিষিয়ে দিচ্ছে। নিমরের মৃত্যুদণ্ডকে নিন্দা করেছে আমেরিকা। কিন্তু সঙ্কট আরও ঘনালে দীর্ঘ দিনের বন্ধু সৌদি আরব না ইরান— সঙ্কটে কোন পক্ষে থাকবে আমেরিকা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy