ভারতীয় সময় অনুযায়ী সোমবার রাত প্রায় সাড়ে ৩টে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় চমকে উঠল সারা বিশ্ব। ইজ়রায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে বলে নিজের সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনটি পোস্ট করে দাবি করলেন তিনি। ঠিক যেমনটা তিনি দাবি করেছিলেন গত ১০ মে। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের আবহে।
কিন্তু নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ গত ১০ মে ট্রাম্পের ঘোষণার পরেই পৃথক পৃথক ভাবে বিবৃতি দিয়ে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে সমঝোতার কথা স্বীকার করেছিল। এ বার কিন্তু তেহরানের তরফে প্রাথমিক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে ট্রাম্পকে। যদিও বেলা গড়াতে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েসকিয়ান বার্তা দিলেন রক্তপাত ও প্রাণহানি এড়াতে তাঁরা মেনে নিচ্ছেন সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব। যদিও তার পরেই তেহরান এবং তেল আভিভের তরফে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে হয়েছে ট্রাম্পকে। ফলে শেষ পর্যন্ত আদৌ সংঘর্ষবিরতি আদৌ হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সোমবার রাতে কাতারে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরান। তার পরেই যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের এই ‘অতিসক্রিয়তা’য় প্রশ্ন উঠেছে।
কী ঘোষণা করলেন ট্রাম্প?
সোমবার রাতে সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘‘এই সংঘর্ষবিরতির সিদ্ধান্তে ইরান ও ইজ়রায়েল দু’দেশই সহমত হয়েছে। আগামী ছ’ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ সংঘর্ষবিরতি শুরু হবে। প্রথমে ইরান সংঘর্ষবিরতি শুরু করবে এবং তার ১২ ঘণ্টা পরে ইজ়রায়েল তা অনুসরণ করবে। ২৪ ঘণ্টা পর দু’দেশের মধ্যে ১২ দিনের টানা যুদ্ধ শেষ বলে ঘোষণা করা হবে। এক পক্ষের সংঘর্ষবিরতি চলাকালীন অপর পক্ষকেও শান্তি বজায় রাখতে হবে।”
পরের পোস্টে ট্রাম্প দু’দেশকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখেন, “১২ দিনের যুদ্ধ শেষ করার মতো ক্ষমতা, সাহস ও বুদ্ধিমত্তা আছে এই দুই দেশেরই। তাই তাদেরকে জানাই অভিনন্দন। এই সংঘর্ষ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারত। গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিতে পারত এই সংঘর্ষ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই যে এটা হয়নি। আর হবেও না। ঈশ্বর সকলকে রক্ষা করুক।” “সংঘর্ষবিরতি এখন থেকে কার্যকর হচ্ছে। দয়া করে লঙ্ঘন করবেন না।”
তেহরান ও তেল আভিভের প্রতিক্রিয়া
সংঘর্ষবিরতি সংক্রান্ত ট্রাম্পের দাবি প্রাথমিক ভাবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। তিনি এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, “আমেরিকার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত আমাদের সংঘর্ষবিরতির বিষয়ে কোনও চুক্তি হয়নি। তবে ইজ়রায়েল নতুন করে হামলা না করলে, আমরাও আর সংঘাতে জড়াব না।” তিনি জানান, ইরান কোনও সংঘর্ষ শুরু করেনি। ইজ়রায়েলই প্রথমে ইরানে হামলা চালিয়েছিল (গত ১২ জুন ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’)। তাই যুদ্ধবিরতি প্রথমে ইজ়রায়েলকেই কার্যকর করতে হবে।
ইরানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক গোষ্ঠী ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ)-এর তরফে জানানো হয়, তারা ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির পথে হাঁটছে। ইরানের বিবৃতিতে এ-ও বলা হয় যে, জায়নবাদী (ইহুদি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ) শত্রু এবং তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” বলা হয়, ‘শত্রুর নিষ্ঠুরতা’র সমুচিত জবাব দিয়েছে ইরানের সেনাবাহিনী।
সেই সঙ্গে ইরানের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, শত্রুপক্ষ যদি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে, তবে তারাও পাল্টা হামলা চালাবে। অন্য দিকে, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সংঘর্ষবিরতি মনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই তেহরানের বিরুদ্ধে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে নতুন করে হামলা শুরুর কথা জানায় ইজ়রায়েল।
নতুন করে সংঘর্ষ, ট্রাম্পের অসন্তোষ
ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাট্ৎজ় নতুন করে হামলা শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ইরানকে নিশানা করে শুরু হয় অভিযান। দুপুর গড়ানোর আগেই পুরদস্তুর ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধে নামে তেহরান-তেল আভিভ। ইরান জানায়, ইজ়রায়েলি হানায় ন’জন নিহত হয়েছেন। অন্য দিকে, নেতানিয়াহু সরকার অভিযোগ করে, মঙ্গলবার সকালে ইজ়রায়েলের দক্ষিণ প্রান্তে বেরশেভা শহরে একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে। ওই হামলায় অন্তত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে ইজ়রায়েল।
ভারতীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ (ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল ৭টা) সমাজমাধ্যমে আরও একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। তাতে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তাঁর বার্তা, “ওই বোমাগুলি ছুড়ো না। তুমি যদি এটা করো, তবে (যুদ্ধবিরতির শর্তে) বড় লঙ্ঘন হবে। এখনই তোমার পাইলটদের (ইরান থেকে) ফিরিয়ে নাও।” ইজ়রায়েল দাবি করে, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে হামলা চালিয়েছে ইরান। তাই ইরানের প্রাণকেন্দ্র তেহরান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
পশ্চিম এশিয়ায় ‘নজর’ পুতিনেরও
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মঙ্গলবার অভিযোগ করেন, অনেকেই ইরান এবং রাশিয়ার সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে! ‘টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, পেসকভ বলেন, “অনেক মানুষ তেহরান এবং মস্কোর সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে।” তবে নির্দিষ্ট কারও নাম করেননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দফতরের মুখপাত্র। তবে মনে করা হচ্ছে আদতে আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলকেই নিশানা করতে চেয়েছেন পেসকভ।
ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালানোর জন্য মঙ্গলবার আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলের নিন্দাও করেন পেসকভ। ইরানে ইজ়রায়েলি হামলার পরেই জানিয়েছিল, নেতানিয়াহুর পদক্ষেপ শুধু ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ই নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনেরও বিরোধী। রবিবার ইরানের তিন পরমাণু কেন্দ্রে মার্কিন সেনার ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’-এর পর রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ‘‘এত দিনে এটা স্পষ্ট যে, ভয়াবহ উত্তেজনা বৃদ্ধি শুরু হয়ে গিয়েছে, যা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে আরও বিঘ্নিত করে। আমেরিকার এই হামলা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং এতে আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘিত হয়েছে।’’
গত সপ্তাহে ইজ়রায়েল-ইরান সংঘাতের অবসানে মধ্যস্থতা করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পুতিন। তিনি বলেছিলেন, মস্কো এমন একটি মীমাংসা আলোচনায় সাহায্য করতে পারে যা তেহরানকে শান্তিপূর্ণ ভাবে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে ইজ়রায়েলের উদ্বেগও প্রশমিত করবে। কিন্তু তার আগেই ইরানে হামলা চালায় আমেরিকা। মঙ্গলবারের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট, পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে নেই। পুতিন কি সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবেন এ বার?
ইরানে পালাবদল চায় না ওয়াশিংটন
সোমবার নিজের ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে ট্রাম্প ইরানে শাসকবদলের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের শাসনে ইতি টানার বার্তাও দিয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার সেই অবস্থান থেকে সরে এলেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘যদি বলে থাকি, বলেছি। কিন্তু আমি এটা চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সব কিছু শান্ত দেখতে চাই।’’
কেন তিনি ইরানে শাসকবদল চাইছেন না, তা-ও জানিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘শাসকবদলের সময়ে বিশৃঙ্খলা হয়। আমরা সেই বিশৃঙ্খলা দেখতে চাই না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আপনারা জানেন, ইরানিরা খুব ভাল ব্যবসায়ী হয়। ওদের প্রচুর তেল রয়েছে। ওদের ভাল থাকা উচিত। ওদের আবার পুনর্গঠন করার ক্ষমতা থাকা উচিত। ওদের কখনওই পরমাণুশক্তি থাকবে না। তা বাদে ওদের ভাল কাজ করা উচিত।’’