E-Paper

‘আমাদের থামানো যাবে না’

প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ করায় গত ন’দিন ধরে উত্তাল দেশ। সর্বত্র দেশবাসী রাস্তায় নেমেছেন।

শ্রেয়স সরকার

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০৭:৫৫
A Photograph of a protestor

রক্তাক্ত বিক্ষোভকারী। শুক্রবার প্যারিসে। ছবি: রয়টার্স।

ফুভ্যিয়ের পাহাড় চূড়া থেকে শতাব্দী-প্রাচীন রোমান নাট্যশালার ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত মানুষের ঢল। হাজার হাজার মানুষের সেই বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে ধ্বনি উঠল— ‘অন এ লা... আমাদের থামানো যাবে না... আমরা এখানেই থাকছি!’

প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ করায় গত ন’দিন ধরে উত্তাল দেশ। রাজধানী প্যারিস থেকে বর্দো, মার্সেই, আমি যে শহরে থাকি সেই লিয়ন— সর্বত্র দেশবাসী রাস্তায় নেমেছেন। সে দিন লিয়নের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এই যে হাজার হাজার মানুষ অবসরের বয়স নিয়ে এত বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছেন, এ রকম ঘটনা কি আগে কখনও দেখেছে এ দেশ? পেনশনের প্রসঙ্গ উঠলেই কেন ফরাসিরা এমন চরমপন্থী আচরণ করেন? পাশে দাঁড়ানো বন্ধু লরোঁকে জিজ্ঞাসা করায় ও বলল, ‘‘এটা অতীতেও করার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাক শিরাক কিছু অসামরিক কর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তখন কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভে ভেঙে পড়েছিল ফ্রান্স। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদ করার পরে সরকার সে বার সংস্কারের প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয়।’’

ইউরোপের শিল্পায়িত দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্সে অবসরের বয়স সব থেকে কম। হিসাব বলছে, সরকারি ব্যয়ের ১৪ শতাংশ যায় অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দিতে। এই প্রেক্ষিতে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে, অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দাবি, মাকরঁ সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’, অর্থাৎ সাংবিধানিকক্ষমতা ব্যবহার করে। আর তাতেই আরও ক্ষেপে গিয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ।

আমার সামনের সারিতে দাঁড়ানো এক বিক্ষোভকারী তরুণীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা— ‘মাকরঁ, ভল্যুউর দ্য ভি! জীবন অপহরণকারী মাকরঁ’। অনেক বিক্ষোভকারীর মুখেই এই কথা— ‘‘যত দিন কফিনে না-ঢুকছি, তত দিন কাজ করিয়ে নেবে এই সরকার।’’ মানুষের আয়ু এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে, ফলে অবসরের বয়স বাড়ানো যেতে পারে, সরকারের এই যুক্তি মানতে নারাজ তাঁরা। এই সব ভাবতে ভাবতে হেঁটে চলেছি, কানে এল বিখ্যাত ফরাসি গাথা ‘ও মা বেল রব্যেল (ও আমার সুন্দরী বিপ্লবী)। আর একটু দূরে কারা যেন গাইছেন সেলিন ডিয়নের গান। পাশে সার গিয়ে দাঁড়িয়ে ফরাসি পুলিশ জঁদর্মারি নাৎসিয়োনাল। এ বার একটু একটু সাবধান হলাম, কারণ এর আগের শুক্রবার, ১৭ই মার্চের সান্ধ্য-বিক্ষোভে লিয়ন শহরের পৌরসভা ভবনে আগুন লাগিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। সেই ঘটনার পরে পুলিশ ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল।

এর আগের সপ্তাহে প্যারিসে একটি জরুরি কাজে গিয়েছিলাম। তখনও প্লাস দ্য লা বাস্তিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গ দিয়েছিলাম। রাস্তায় নেমে জনপ্রতিবাদ ফরাসি ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম। গত মঙ্গলবার, ১৪ই মার্চের ভিড় বলে দিচ্ছিল, ফরাসিরা এখনও যথেষ্ট ‘এতিহ্যবাহী’! সরকারি অনুমান, সে দিন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ১২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ। যদিও ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবি, সে দিন রাস্তায় ছিলেন সাড়ে ৩৪ লক্ষ মানুষ।

প্যারিসের প্রতিবাদ-মিছিলে বরাবরই একটি স্বতন্ত্র শিল্পভাবনা জুড়ে থাকে। কোনও বিক্ষোভে দেখা যায় বিখ্যাত ব্যালে ‘সোয়ান লেক’-এর প্রদর্শনী, কোথাও বা আবার সপ্তদশ শতকের নাট্যকার মলিয়্যেরের কমেডি অভিনয় করা হয়। এ বারের সমাবেশে চোখে পড়ল এক তরুণীর সঙ্গে এক অতিকায় পুতুল, তার নাম ‘জুসস্তিস’ (ন্যায়)। পাল্কিতে করে সে এগিয়ে আসছে। জুসস্তিসের সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, মুখমণ্ডল রক্তাক্ত, নাট্যকুশলীরা ঝাঁকেঝাঁকে তির নিক্ষেপ করছে জুসস্তিসকে।লেখা— ‘অ্যাটাক দ্য কর্বো কিউপিদিটে (লোভের কাকের আক্রমণ)’।

ভিড়ের মেজাজও আলোর গতিতে পরিবর্তিত হতে পারে। উষ্ণ, কার্নিভালের আবহাওয়া থেকে হঠাৎ বদলে গেল সব। আমার চারপাশের কিছু লোক হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর পিছনে হাঁটতে শুরু করল। আমার পাশেই ছিলেন কয়েক জন আলোকচিত্ৰী। তাঁরা ব্যাগ থেকে নিরাপত্তা হেলমেট বার করে পরে ফেললেন। দেখলাম কালো পোশাকপরা একদল প্রতিবাদকারী, বুলেভার্ডের ও-পারের পুলিশ অফিসারদের সারিগুলির সঙ্গে হিংস্রভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রুত পা চালিয়ে অন্য রাস্তা নিলাম। তত ক্ষণে কাঁদানে গ্যাসে ঝাপসা হতে শুরু করেছে চারপাশ, বিভ্রান্ত বিক্ষোভকারীরা অবরুদ্ধ রাস্তা থেকে বাড়ি ফেরার পথ খুঁজতে ব্যস্ত।

আজও মিছিলে পা মিলিয়েছি। কারা যেন লিয়োনার্ড কোহেনের গান গাইছে, ‘আহা, বাতাস, বাতাস বইছে কবরের ভেতর দিয়ে বাতাস বইছে শীঘ্রই স্বাধীনতা আসবে তারপর আমরাছায়া থেকে আসব...।’ সূর্যাস্তের স্বর্ণাভা সস্নেহে সামনের মাথাগুলির উপরে হাত বুলিয়ে দেয়। প্রতিবাদে ক্ষান্তি দিয়ে সারি সারি অপ্রতিম, অপ্রতিরোধ্য মানুষ নামে ফুভ্যিয়ের পাহাড় থেকে। সন্ধ্যা নামে গাঢ় হয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Pension Protest france Emmanuel Macron

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy