বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। সাদা চোখে তা অবশ্য দেখা যাচ্ছে না, যাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু ওপার বাংলার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের একাংশের মতে, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ়-জ়ামানের সম্পর্ক তিক্ততর হচ্ছে। সূত্রের খবর, দিন দুয়েক আগে ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর আপত্তি ক্ষোভের সঙ্গেই জানান ওয়াকার। সেনাবাহিনী, জনতা সন্ত্রাস এবং নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি— এই ত্র্যহস্পর্শেই নাকি ইউনূস, ওয়াকার সম্পর্ক কার্যত আর মেরামতের জায়গাতেও নেই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডিভিশনগুলির মধ্যে কৌশলগত ভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নবম পদাতিক ডিভিশন। তারা সাভার তথা ঢাকা অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে এবং রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানের সুরক্ষা দেখভাল করে। এই ডিভিশনের জিওসি ছিলেন ওয়াকারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত মেজর জেনারেল মইন খান। গত ২১ অগস্ট তিনি অবসর নেন। তাঁর চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য অনেক আগে সেনাপ্রধান সুপারিশ করলেও প্রধান উপদেষ্টা তাতে সাড়া দেননি বলেই সূত্রের খবর। তাতে বেজায় চটেছেন ওয়াকার।
নবম পদাতিক ডিভিশনের নতুন জিওসি এবং সাভারের এরিয়া কমান্ডার করা হয়েছে মেজর জেনারেল এস এম আসাদুল হককে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্দরের খবর, এই আসাদুল জামায়াতে ইসলামী মনোভাবাপন্ন এবং তীব্র আওয়ামী লীগ বিরোধী বলে পরিচিত। সেনাবাহিনী সূত্রের খবর, গত মার্চে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে একাদশ পদাতিক ডিভিশনে পোস্টিং পান আসাদুল। ওই সময়ের পর থেকে সেখানে বঙ্গবন্ধুর যত মূর্তি-মুরাল সব ভাঙা হয়েছে। ওই ডিভিশনে দফতরেও নাকি বঙ্গবন্ধুর কোনও ছবিও রাখতে দেননি ওই সেনা অফিসার। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমীকরণে আসাদুল ওয়াকারের কাছের লোক নন বলে জানাচ্ছে ওই সূত্রটি। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের এক প্রাক্তন সেনা অফিসার বলেন, ‘‘অতীতে যত অভ্যুত্থান হয়েছে, তার পিছনে এই নবম পদাতিক ডিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে ওই ডিভিশনের শীর্ষপদে নিজের লোক না থাকায় সেনাপ্রধান কিছুটা অস্বস্তিতে থাকতেই পারেন।’’ সূত্রের খবর, ইউনূসকে ওয়াকার এ-ও বলেছেন, সেনার তরফে পাঠানো পদোন্নতির সুপারিশ-সহ ৭১টি ফাইল প্রধান উপদেষ্টার দফতরে পড়ে রয়েছে। এ ভাবে কি সেনাবাহিনী পরিচালনা করা যায়!
সেনাপ্রধানের ক্ষোভের আর একটি কারণ, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার উত্তরোত্তর অবনতি। ওয়াকারের যুক্তি, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরে তিনিই দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনি আইনশৃঙ্খলা ঠিক থাকবে ও নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার গঠনের পরে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। কিন্তু বর্তমানে যত্রতত্র জনতা-সন্ত্রাস চলছে। দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। আর এর জন্য ওয়াকার দায়ী করছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি)-কে। আর একটি সূত্রের খবর, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি জানিয়েছেন, এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা রাজনীতি করুন— তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু হিংসাত্মক কাজ করলে সেনা চুপ করে থাকবে না। ওই প্রাক্তন সেনা কর্তার কথায়, ‘‘দেশের আইনশৃঙ্খলার ভার এখন সেনাবাহিনীর হাতে। কোনও নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে তার দায় বর্তাবে সেনাপ্রধানের উপরে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গত কারণ রয়েছে।’’ সূত্রের দাবি, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে আর আপসে রাজি নন ওয়াকার। ইউনূসকে প্রকারান্তরে তিনি জানান, ‘অবিলম্বে এই ছাত্রনেতাদের সামলান’।
ওই সূত্রের দাবি, ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে ওয়াকার জানিয়ে দিয়েছেন, ভোট নিয়ে টালবাহানা সেনা আর বরদাস্ত করবে না। ফেব্রুয়ারিতেই যাতে ভোট হয়, ওয়াকার তা নিশ্চিত করতে বলেছেন ইউনূসকে। সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত বাজেট বরাদ্দের কথাও তুলেছেন। রাজনৈতিক ও কূটনীতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, সেনাপ্রধান যে সব উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন, তা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা কতটা কী করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদি তা না পারেন তা হলে বাংলাদেশ আরও একটি নতুন বাঁকের মুখোমুখি হতে পারে বলে তাঁদের ধারণা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)