ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘দাবি’ নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় ছিল। ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে মার্কিন হামলার পর থেকে যে সব প্রাথমিক রিপোর্ট এবং উপগ্রহচিত্র প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছিল, তাতে দানা বাঁধছিল বিভ্রান্তিও। সংবাদমাধ্যমের সামনে ঠিক কী বলা উচিত, কতটা বলা উচিত, তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন মার্কিন প্রশাসনের আধিকারিকেরা। বুঝেশুনে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছিলেন তাঁরা। কতটা বললে তথ্যের অপব্যাখ্যা করা হবে না, আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘দাবি’ও খারিজ করা হবে না, তা মাথায় রাখতে হচ্ছিল আধিকারিকদের। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট ‘ফাঁস’ হতেই আরও ফ্যাসাদে পড়েছেন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা।
মার্কিন হানায় ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ড সামান্য হোঁচট খেয়েছে মাত্র, পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি! এমনটাই আভাস মিলেছে আমেরিকার গোয়েন্দাদের প্রাথমিক রিপোর্টে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমেরিকার হামলায় দু’টি পরমাণুকেন্দ্রের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভূগর্ভস্থ ভবনগুলিকে ধ্বংস করা যায়নি। ফলে ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ড কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে গিয়েছে মাত্র।
এখানেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, হামলার পরে পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি ‘নিশ্চিহ্ন’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে!’’ শুধু এক বার নয়, ওই একটি শব্দ ট্রাম্প বেশ কয়েক বার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রাথমিক রিপোর্ট অন্য কথাই বলছিল। বলা হচ্ছিল, ইরানের তিন পরমাণুকেন্দ্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে ‘মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে, যা ট্রাম্পের ‘দাবি’র সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানে মার্কিন হামলার পর থেকে সংবাদমাধ্যমে যে সব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনিক আধিকারিকেরা সংবাদমাধ্যমে কী বিবৃতি দিচ্ছেন, সে দিকেও কড়া নজর রেখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়েই বলেছেন, ‘‘যা দেখলাম, তাতে আমাদের বোমা হামলার পর আর পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা নেই ইরানের। আমাদের বোমা ঠিক জায়গাতেই পড়েছে। সঠিক লক্ষ্যেই আঘাত করেছে।’’
কিন্তু মার্কিন সংবাদপত্র যে গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, হামলার পর প্রশাসনিক আধিকারিকেরা যা ভেবেছিলেন, ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলি ততটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত সরঞ্জামই ইরানের হাতে রয়েছে। চাইলে খুব শীঘ্রই পরমাণু বোমা বানাতে পারবে তারা।
গোয়েন্দা রিপোর্ট ফাঁস হতেই বিড়ম্বনায় পড়েছেন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। এই পরিস্থিতিতে ওই রিপোর্টকেই উড়িয়ে দিয়েছেন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট। তিনি বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ ভুল!’’ গোয়েন্দা রিপোর্ট ফাঁসকেও ট্রাম্পের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা বলে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা নয়, যে সেনারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিই ধ্বংস করে এল, তাঁদেরও খাটো করা হচ্ছে।’’
ক্যারোলাইনের যুক্তি, ‘‘৩০ হাজার পাউন্ডের ১৪টা বোমা কোথায় ফেলা হলে কী হতে পারে, তা সকলেই জানেন। সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’’ যদিও সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন যে, ইরানের ফোর়ডো, নাতান্জ এবং ইসফাহান পরমাণুকেন্দ্রগুলি যে ঘেরাটোপে রয়েছে, তাতে এক দিনের হামলায় তা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। শুধু ১৪টি বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেললেও হবে না। লাগাতার হামলা চালিয়ে যেতে হবে।
এখন দেখার, আগামী বৃহস্পতিবার সেনেটে এবং শুক্রবার হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ্স-এ ইরানে হামলা এবং তার ফলাফল নিয়ে কী বিবৃতি দেয় সরকার পক্ষ।