Advertisement
২৬ মে ২০২৪

এ কী হাল স্বাস্থ্যের! উদ্বিগ্ন আমেরিকা

সমৃদ্ধির জোয়ার চারপাশে। ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল, আধুনিকতম পরিকাঠামো, দক্ষ ডাক্তার, গবেষণায় অন্যান্য দেশের থেকে বহু যোজন এগিয়ে। তবু স্বাস্থ্য নিয়ে আমেরিকার ‘সুখ নেইকো মনে’।

সোমা মুখোপাধ্যায়
আটলান্টা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ০৩:০৫
Share: Save:

সমৃদ্ধির জোয়ার চারপাশে। ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল, আধুনিকতম পরিকাঠামো, দক্ষ ডাক্তার, গবেষণায় অন্যান্য দেশের থেকে বহু যোজন এগিয়ে। তবু স্বাস্থ্য নিয়ে আমেরিকার ‘সুখ নেইকো মনে’।

মার্কিন সরকারের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম-এ ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে এই দেশে এসে দেখা যাচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক-গবেষক, নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কলেজ পড়ুয়া, ব্যাঙ্ক কর্মী থেকে শুরু করে সান দিয়েগোর পার্কের বাইরে বসে থাকা গৃহহীন, একটা বড় অংশেরই হা-হুতাশ, মোটে ভাল নয় স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল। মাস কয়েক আগে কাইজার ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে স্বাস্থ্য নিয়ে ৪৫% মানুষের মনোভাব নেতিবাচক। মোটামুটি ইতিবাচক মনে করেন ৪৩%। বাকিরা মতামত দেননি।

এই মুহূর্তে ‘ওবামা কেয়ার’ তথা আমেরিকার ‘অ্যাফর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ নিয়ে সরগরম গোটা বিশ্ব। ৭ বছর আগে বারাক ওবামার চালু করা এই আইনকে নস্যাৎ করতে চেয়ে বারবার ধাক্কা খাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই টানাপড়েনে রীতিমতো বিভ্রান্ত আমজনতা। তাঁদের একটা বড় অংশের মতে, স্বাস্থ্য পরিষেবা সকলের নাগালের মধ্যে থাকাটাই কাম্য। তাই তাঁরা চাইছেন, ‘ওবামা কেয়ার’ থাকুক। শুধু এর ত্রুটিগুলি শুধরে নেওয়া হোক। বিমা সংস্থাগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ বাড়াক প্রশাসন। তাঁদের বক্তব্য, উন্নয়নের জোয়ার বইছে আমেরিকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। কিন্তু তার খরচ এত বেশি যে, সেই উন্নয়নের সুফল কাজে লাগাতে পারছেন না তাঁরা।

মেয়ো ক্লিনিক বা ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালে বেশ ক’জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঘৃণা করেন। ‘‘কারণ সাধারণ মানুষ এই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পান না। আমরা চিকিৎসক হিসেবে তখন অসহায় হয়ে পড়ি,’’ বলছেন এক শল্য চিকিৎসক।

হার্ভাড এবং এমআইটি-র এক সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, আমেরিকার প্রায় অর্ধেক মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। মার্কিন নাগরিকরা এই সমীক্ষায় জানিয়েছেন, বিমা থাকা সত্ত্বেও সব সময়ে তাঁরা এই চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেন না। বিমা সংস্থা খরচ দেওয়ার পরেও যে অংশটা রোগীকে মেটাতে হয়, সেটা বিপুল। ব়ড়সড় অসুখ হলে তো দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়!

সান দিয়েগোর এক অবসরপ্রাপ্ত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এমা রবার্ট বললেন, ‘‘আমি যে বিমা করিয়েছি, তার প্রিমিয়াম যথেষ্ট বেশি। বিমা সংস্থা ৮০% দেয়। কিন্তু যে বাকি ২০% মেটাতে গিয়েই ফতুর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পোষা কুকুরের জন্যও চিকিৎসা বিমা করানো আছে। নয়তো বড় অসুখ হলে চিকিৎসাই করানো যাবে না খরচের ধাক্কায়।’’

এ দেশে সাধারণ ভাবে কর্মীদের বিমার ব্যবস্থা করেন নিয়োগকর্তারাই। কিন্তু রাস্তার ধারের ফাস্টফুড সেন্টার বা ছোট কল সেন্টারের মতো খুব ছোট সংস্থার কর্মীদের বিমা থাকে না বহু ক্ষেত্রে। এঁরা ‘আংশিক সময়ের কর্মী’, এই যুক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় এড়ান। এই বিপুল সংখ্যক কর্মী ও আরও বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ যাঁরা গরিবদের জন্য তৈরি হওয়া ‘মেডিকেড’ প্রকল্পের বাইরে রয়েছেন, তাঁদের সকলকেই বিমার আওতায় আনতে চেয়েছিলেন ওবামা। কিন্তু অধিকাের হস্তক্ষেপ ও বেশি প্রিমিয়ামের অভিযোগ তুলে অনেকে এই বিমা করাননি।

এঁদের অনেকের বক্তব্য, ‘ওবামা কেয়ার’ গরিবদের জন্য ভাল। কিন্তু গরিবদের ভর্তুকি দিতে হবে বলে বিমা সংস্থাগুলি যে ভাবে বাকিদের বিমার প্রিমিয়াম বাড়াচ্ছে, তাতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। গরিবদের সাহায্য করতে হলে সরকার করুক, নাগরিকরা কেন তার দায় নেবে সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

বস্তুত, গরিব নাগরিকদের জন্য যে ‘মেডিকেড’ প্রকল্প চালু আছে, এই মুহূর্তে তার আওতায় আছেন ৭ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি মার্কিন। ওবামা চেয়েছিলেন, এই প্রকল্প আরও বিস্তৃত হোক। ট্রাম্প এসে তাতেও বাদ সাধছেন। ট্রাম্পের পরিকল্পনা— ‘মেডিকেড’ বদলে আমেরিকার প্রদেশগুলিকে আলাদা ভাবে কিছু অর্থ (ব্লক গ্রান্ট) দেওয়া হোক। তারা গরিবদের জন্য প্রয়োজন মতো তা খরচ করবে। আমেরিকার সাধারণ গরিব মানুষ এতে আতঙ্কিত। তাঁদের বক্তব্য, ‘মেডিকেড’ বাতিল হলে তাঁরা বিনা চিকিৎসায় মরবেন। যে ভাবে কাগজে-কলমে প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও তার সুযোগ পান না বহু গৃহহীন, যে ভাবে টাকা না থাকা গরিবদের এমার্জেন্সি চিকিৎসা করতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও বহু হাসপাতাল তা মানে না, সেই ভাবেই এই ব্লক গ্রান্টও কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। তার সুফল পাওয়া যাবে না।

এই কারণে শুধু ওবামার প্রতি বিদ্বেষ থেকে ‘ওবামা কেয়ার’ নস্যাৎ না করে, বরং তার ত্রুটিগুলো শুধরে সেটাকেই নতুন রূপ দেওয়া হোক, একটা বড় অংশের আমেরিকাবাসী এখন সেটাই চান। তাঁদের বক্তব্য, প্রযুক্তি-গবেষণায় এগিয়ে থাকা দেশ এ বার এ দিকটা নিয়েও ভাবুক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

USA Health Care
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE