Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Hillary Clinton

চারটে স্টেট ঠিক করে দেবে কে জিতবে

আমেরিকার এই নির্বাচন একটু বিচিত্র। পপুলার ভোটে জিতে আসার গল্প এ নয়। এখানে জেতা মানে ইলেক্টোরাল কলেজে জেতা। সব মিলিয়ে ৫৩৮টা ভোট এই ইলেক্টোরাল কলেজে। ফলে যে ২৭০ পার করবে, সেই জয়ী। এই সূত্রে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ বুশ ২৭১-২৬৬ ইলেক্টোরাল ভোটে জিতলেও পপুলার ভোটে প্রায় ৫ লাখ ভোটে হেরেছিলেন।

ক্লিন্টন না  ট্রাম্প ?

ক্লিন্টন না ট্রাম্প ?

রানা আইচ
স্যান হোসে, ক্যালিফোর্নিয়া শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৬ ১৪:২২
Share: Save:

মার্কিন মুলুকে প্রায় দেড় বছর ধরে চলা প্রেসিডেন্ট ভোট যুদ্ধ আর এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হতে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, ভোটের নামে এই রঙ্গ আর নেওয়া যাচ্ছে না! সবার মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। প্রায় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। কে জিতবে বলা বেশ মুশকিল।

এত বড় রিয়েলিটি শো যাতে ভরপুর ‘এন্টারটেইমেন্ট’ আছে, তাতে শেষ মুহূর্তে একটু মশলা তো মেশাতেই হবে। নয়তো পাবলিক খাবে কেন? তাই, অবধারিত ভাবে ভোটের ঠিক আগের সপ্তাহে সব বাছা বাছা কেলেঙ্কারিগুলো ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঠিক তার পিছু পিছু জনমত সমীক্ষাগুলোর ব্যবধান এক অজানা জাদুমন্ত্রে আরও কমে যায়। অক্টোবর মাসের শেষে যুযুধান দুই পক্ষই এই কাদা ছোড়াছুড়ির খেলায় হৈ হৈ করে নেমে পড়ে, যা এখানে ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ নামে খ্যাত। ভাল মাপের কেলেঙ্কারি সামনে এলে মিডিয়াতে তা নিয়ে কাঁটাছেড়া চলে অষ্টপ্রহর। তাই ভোট নিয়ে তীব্র অনীহা থাকা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সবার মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে সেই লাখ টাকার প্রশ্ন, কে জিতবেন? হিলারি ক্লিন্টন না ডোনাল্ড ট্রাম্প?

এ দেশে সবাইকে চাকরিতে ঢুকে প্রথমেই যে পাঠ নিতে হয় তা হল ‘কমপ্লায়েন্স ট্রেনিং’। কাজ করতে এসেছেন ভাল কথা, কিন্তু এগুলো বাপু আমাদের কোম্পানির রুলস আ্যন্ড রেগুলেশনস, দয়া করে একটু চোখ বুলিয়ে নিন— এই হল সেই ট্রেনিং-এর মোদ্দা কথা। ওবামা যখন ২০০৮-এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তখনও এ দেশের পত্র-পত্রিকাতে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল, উনি কী কী করতে পারবেন আর পারবেন না। কিন্তু ২০০৯-এ ওবামার ক্যাবিনেটে সেক্রেটারি অফ স্টেট নিয়োগ হওয়ার পরেই বিদেশ মন্ত্রকের কিছু নিয়ম কানুন বা অনুশাসন নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিলেন হিলারি ক্লিন্টন। যেমন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট মেল সার্ভার ব্যবহার না করে উনি নিজস্ব মেল সার্ভার ব্যবহার করা শুরু করলেন।

সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু ২০১৫-র মার্চ মাস নাগাদ এই কথা সর্বসমক্ষে ফাঁস হয়ে যায়। তার পর থেকেই শুরু যত বিপত্তির। তত দিনে ক্লিন্টন ২০১২-য় বিদেশ সচিবের পদে ইস্তফা দিয়ে, ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য জমি তৈরি করছেন। রিপাবলিকানরা বেজায় চেঁচামেচি শুরু করে এই নিয়ে। এবং ব্যাপারটা এফবিআই পর্যন্ত গড়ায়। গত জুলাই মাসের ৫ তারিখে এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কোমি কিঞ্চিত বকাঝকা করে ছেড়েও দেন হিলারিকে। এর ফলে সবচেয়ে রুষ্ট হন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকানেরা। তারা আমেরিকার জনগণকে বোঝাতে শুরু করে যে, পুরো সিস্টেমটাই রিগ্ড। আমরা অধমেরা ভাবলাম, বুঝিবা হিলারির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ সরে গেল। অধিকাংশ জনমত সমীক্ষা হিলারিকে এগিয়ে রেখেছিল এই সে দিন পর্যন্ত। কিন্তু, অক্টোবর মাসের সারপ্রাইজ তা হলে আছে কী করতে? তাই গত সপ্তাহে এফবিআই আবার গা ঝাড়া দিয়ে বাজারে নেমে পড়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে চিঠি দিয়ে ডিরেক্টর কোমি জানিয়েছেন, হিলারিকে বেকসুর নির্দোষ এখনও যাবে না। তাঁর মতে, হঠাৎ করে কিছু ই-মেলের উপর আতসকাচ ফেলাটা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাল ঠুকে বলেছেন, ‘‘ভুল বলেছিলাম, আফটার অল আওয়ার সিস্টেম ইস নট সো রিগ্ড।’’

আমেরিকার এই নির্বাচন একটু বিচিত্র। পপুলার ভোটে জিতে আসার গল্প এ নয়। এখানে জেতা মানে ইলেক্টোরাল কলেজে জেতা। সব মিলিয়ে ৫৩৮টা ভোট এই ইলেক্টোরাল কলেজে। ফলে যে ২৭০ পার করবে, সেই জয়ী। এই সূত্রে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ বুশ ২৭১-২৬৬ ইলেক্টোরাল ভোটে জিতলেও পপুলার ভোটে প্রায় ৫ লাখ ভোটে হেরেছিলেন।

দীর্ঘ দিনের এই রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটের তুলকালাম রেষারেষিতে লাভের লাভ যা হয়েছে, তা হল আধিকাংশ স্টেটই একই পার্টিকে জিতিয়ে আসছে বহু দিন ধরে। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট জয়ী হওয়ার মতো। ফলে এক দিকে যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্কের লোকেরা হৈ হৈ করে ডেমোক্র্যাট পার্টিকে জেতাচ্ছে আজ প্রায় কুড়ি বছর হল, ঠিক তেমনই টেক্সাস, লুইজিয়ানা, টেনেসি ইত্যাদি স্টেটের বাসিন্দারা যুগ যুগ ধরে রিপাবলিকানদের ভোট দিয়ে আসছেন। ফলে হাতে গোনা কিছু স্টেট পড়ে থাকে যাদের নিয়ে শুরু হয় দড়ি টানাটানি। মার্কিন রাজনীতিতে যার নাম ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটস। এই রকম কিছু স্টেট হচ্ছে পেনসিলভেনিয়া (২০টি ইলেক্টোরাল ভোট), নিউ হ্যাম্পশায়ার (৪), নেভাদা (৬), ওহায়ো (১৮), আইওয়া (৬), ফ্লোরিডা (২৯), নর্থ ক্যারোলিনা (১৫), কলোরাডো (৯) আর নিউ মেক্সিকো (৫)। হিলারি এবং ট্রাম্প এই সব স্টেটে চরকিপাক খেয়ে ক্যাম্পেন করে চলেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫) ও নিউ ইয়র্কে (২৯) ইলেক্টোরাল কলেজ ডেমোক্র্যাটদের বাধা বলে হিলারি বা ট্রাম্প কেউ সেখানে ক্যাম্পেন করেননি। তেমনই টেক্সাসের ৩৮টা ভোট রিপাবলিকানদের হয়েই রয়েছে। অতএব টেক্সাসও ক্যাম্পেনের গুঁতো থেকে বেঁচে গিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটসগুলোতে কী ফল হতে পারে? এর প্রচুর হিসেবপত্তর আছে। সকলেই সব রকম কম্বিনেশনে হিসেব করে দিস্তে দিস্তে বাইট খরচা করছে। তার মধ্যে অনেকেই একটা সোজা হিসেব কষছেন।

হিলারিকে জিততে হলে ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটসগুলোতে মিনিমাম ক’টা ইলেক্টোরাল ভোট জিততে হবে? দেখা যাচ্ছে নিউ হ্যাম্পশায়ার, পেনসিলভেনিয়া, কলোরাডো আর নিউ মেক্সিকোতে জিততে পারলেই সিংহাসনে বসতে পারবেন তিনি। তবে তার সঙ্গে এও ধরে নেওয়া হচ্ছে উইসকনসিন, মিশিগান ও মিনেসোটাতে জিতবেন। গত বার ওবামাও জিতেছিলেন এই জায়গাগুলিতে। এই তিনটে না জিতলে স্বীকার করে নিতেই হবে ট্রাম্প ঝড়ের কথা। একমাত্র এই সমীকরণেই হিলারি মেরেকেটে ২৭০-এর উপরে চলে যাবেন। আর না হলে? ট্রাম্পের দাদাগিরি দেখার সুযোগ পেয়ে যাব আমরা।

উপরের ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, ২০১২-য় ওবামা ৩৩২টা ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছিলেন। আর মিট রামনি ২০৬-এ ঠেকে গিয়েছিলেন। তার মানে ট্রাম্পকে জিততে হলে ২০১২-র সব রেড স্টেটগুলো জিততেই হবে। আর ওবামার কলাম থেকে আরও ৬৪টি ইলেক্টোরাল ভোট ছিনিয়ে আনতে হবে। আর এখানেই চলে আসছে পেনসিলভেনিয়ার গুরুত্ব। কারণ, এই রাজ্যের ভাগে আছে ২০টা ইলেক্টোরাল ভোট। গত ৬টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পেনসিলভেনিয়ার নাগরিকেরা টানা ডেমোক্র্যাটদের জিতিয়ে এসেছেন। ঠিক এই মুহূর্তে যা ফল আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প ঝড় পেনসিসভেনিয়ার সীমান্তে এসে থমকে আছে। প্রখ্যাত স্ট্যাটিস্টিসিয়ান নেট সিলভারের সাইটে দেখাচ্ছে, এখানে হিলারি এখনও ৫ শকাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন। শতকরা হিসেবে জেতার সুযোগ প্রায় ৮২ শতাংশ। অন্য তিনটে স্টেটেও প্রায় একই কাহিনি। এফবিআই-এর অক্টোবর সারপ্রাইজের দৌলতে এটাই এখন দেখার, ট্রাম্প শেষ সপ্তাহে সত্যি বড় রকম ঝড় তুলতে সক্ষম হন কি না। তাই পরের মঙ্গলবার এই চারটে স্টেটের দিকেই সকলের নজর থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE