কত বোমা চলেছে সমরে। এগুলো ব্যবহার করলেই কি আইএস-কে হারানো যাবে? ছবি: প্রতিবেদক।
রঙিন পোস্টারটা চোখে পড়ল সুবিশাল রণতরীর ছ’তলায়।
দাঁতের রুটিন মেরামতি কিংবা বেয়াড়া আক্কেল দাঁতকে শায়েস্তা করতে এই তল্লাটে আসেন মার্কিন নৌসেনারা। সেই দন্ত চিকিৎসা বিভাগেরই দেওয়ালে সাঁটা দু’টো ছবি সম্বলিত পোস্টার। উপরের ছবিতে হুডখোলা গাড়ির মিছিল। কালো পোশাক পরে, কালো পতাকা উড়িয়ে, একে-৪৭ উঁচিয়ে চলেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিরা। ছবির গায়ে লেখা— ‘আইএস রেবেলস আর হেভিলি আর্মড।’ আইএস জঙ্গিরা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। নীচে বোমারু বিমান বহনকারী কার্ল ভিনসনের ছবিতে লেখা—‘দ্যাটস কিউট।’ ব্যাপারটা খুব মিষ্টি।
বোঝাই যাচ্ছে, আমেরিকার সামরিক প্রতাপের সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের অস্ত্রবলের তুলনা টেনে রীতিমতো রসিকতা করা হয়েছে ওই পোস্টারে। দুপুরে এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার-এর বারো তলার ফ্লাইট ডেকে তখন বোমরুদের ওড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পোস্টারের প্রসঙ্গটা তোলায় কার্ল ভিনসন-এর কম্যান্ডিং অফিসার কার্ল টমাস ফ্লাইট ডেকে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে আনন্দবাজারকে বললেন, “রসিকতা করব না তো কী করব বলুন! ওরা নাকি হেভিলি আর্মড! এ সব আমাদের শুনতে হবে? আমাদের!!!”
আমেরিকার সমর-সম্ভারের সঙ্গে সত্যিই আইএস-এর অস্ত্রশস্ত্রের কোনও তুলনাই চলে না। অন্য সব বোমা তো আছেই, ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নামে এক ভয়ঙ্কর বোমা দেখলাম কার্ল ভিনসনের অস্ত্রাগারে। এক-একটার ওজন তিন হাজার পাউন্ড! আফগানিস্তানের তোরা বোরায় আল কায়দার ঘাঁটি চুরমার করতে এই বোমাই ব্যবহার করা হয়েছিল। এর মোকাবিলায় আইএসের অস্ত্রশস্ত্র? অতিকায় কার্ল ভিনসনের পাশে একটা ডিঙি নৌকো বা ভেলাকে অনেকটা যেমন দেখাবে!
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে। এমন রাক্ষুসে অস্ত্রভাণ্ডার নিয়েও আইএস জঙ্গিদের মুছে ফেলা যাচ্ছে কোথায়? শক্তির বিচারে তো দিন কয়েকের মধ্যেই আইএস-কে পর্যুদস্ত করে দেওয়ার কথা যৌথ বাহিনীর। তা তো হয়নি!
উল্টে কী কী হয়েছে?
ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় আইএস কার্যত নিজেদের রাজধানী তৈরি করে ফেলেছে। এখনও তাদের ওই দু’টো জায়গা থেকে হটানো যায়নি। ইরাকের তিকরিত থেকে টানা তিন দিন আইএস-এর বিরুদ্ধে জোরদার সামরিক অভিযান চললেও নড়ানোই যায়নি জঙ্গিদের। উল্টে বৃহস্পতিবার টাইগ্রিস নদীর তীরে নিমরুদ শহরে বুলডোজার নিয়ে হামলা চালিয়ে প্রাচীন অ্যাসিরীয় সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস করেছে আইএস। উত্তর ইরাকের কারকুক প্রদেশের হাইজা শহরে আট জনের মাথা কেটে তাদের মৃতদেহ প্রকাশ্যে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিয়েছে তারা।
গত ন’মাসে কয়েক হাজার বার বিমান হানা চালিয়ে এই ধরনের নৃশংসতা ও বর্বরতাই যদি আমেরিকা বন্ধ করতে না পারল, তা হলে নিজেদের পরাক্রমের অহঙ্কার করে কী লাভ? বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কার্ল ভিনসন-এর ষোলো তলার ‘অবজারভেশন ডেক’-এ দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। দুপুর দেড়টা নাগাদ যে সব এফ-এ ১৮ই সুপার হর্নেট, এফ-এ ১৮সি হর্নেটদের উড়ে যেতে দেখেছিলাম, চার ঘণ্টা পর তাদের বেশ কয়েকটা ফিরে এল যাবতীয় ক্ষেপণাস্ত্র সমেত। একটাও না ফেলে। কোনও আঘাত না হেনে।
কেন?
উত্তর দিলেন কার্ল ভিনসনের কম্যান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন কার্ল টমাস। বললেন, “বোমারুরা অনেক সময়েই বুঝতে পারছে না, কোথায় আঘাত হানবে। এতটা পথ উজিয়ে গিয়েও সব ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা, রকেট-সহ ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।” ক্যাপ্টেন টমাস আরও জানালেন, এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাইটার জেটগুলো লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে আগাম কোনও তথ্য না পেয়েই কার্ল ভিনসন থেকে উড়ছে। কখনও কখনও মাঝ আকাশে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে পাইলটরা খবর পাচ্ছেন, না-পেলে বোমা নিয়ে ফেরত আসা।
অথচ গড়ে এক-একটি ফাইটারের চার থেকে ছ’ঘণ্টা আকাশে থাকা এবং মাঝ আকাশেই চার বার জ্বালানি ভরার খরচ বিপুল। ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ওয়ানের কম্যান্ডার, রিয়ার অ্যাডমিরাল ক্রিস্টোফার গ্রেডির কথায়, “আইএস জঙ্গিরা ওদের কৌশল পাল্টেছে। ওরা প্রথমে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে পুরোদস্তুর সেনাবাহিনীর মতো এগোচ্ছিল। কিন্তু তাতে ওদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। কিন্তু এখন ওরা কৌশল পাল্টেছে। সেনাবাহিনীর মতো যুদ্ধ ছেড়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো লড়াই করছে।” অন্য সমস্যার কথা বললেন সুপার হর্নেট-এর পাইলট, লেফটেন্যান্ট জেপেটো “ইরাকি সিকিওরিটি ফোর্স (আইএসএফ)-এর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তাই, লক্ষ্যবস্তুর ব্যাপারে সঠিক তথ্য মিলছে না। অনেক সময়েই কোনও আক্রমণ না চালিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছি।” সোজা কথায়, মাটিতে লড়াই করা ইরাকি সেনার কাছ থেকে ঠিকঠাক খবর পাচ্ছে আমেরিকা।
দেখা যাচ্ছে, অভিযানের সাফল্য নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে মার্কিন সেনাপতিদের।
কার্ল ভিনসনে আসার আগের দুপুরে বাহরাইনে মার্কিন নৌসেনার সেন্ট্রাল কম্যান্ড-এর সদর দফতরে বসে কথা হচ্ছিল রিয়ার অ্যাডমিরাল জেমস লোবলাইনের সঙ্গে। সেন্ট্রাল কমান্ড-এর ডেপুটি কম্যান্ডার লোবলাইনের দাবি, “সব কিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে। আমাদের বিমান হানা আইএস-কে সেনাবাহিনী থেকে কয়েকটি ছোট ছোট জঙ্গি গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। এটাই বড় সাফল্য। ওদের কম্যান্ড আর কন্ট্রোলে ভাল রকম ধাক্কা দিয়েছি।”
কিন্তু কার্ল ভিনসনের রিয়ার অ্যাডমিরাল গ্রেডি মনে করছেন, মার্কিন বিমান হানার সঙ্গে ‘খাপ খাইয়ে নিয়েছে’ আইএস। আর ক্যাপ্টেন টমাস বলছেন, “আইএস পিছু হটেছে, এটা কখনওই বলা যাবে না। এটুকু বলতে পারি, আগে ওরা আক্রমণাত্মক ছিল, এখন ওরা রক্ষণাত্মক হয়েছে। কিন্তু সময়ে সময়ে রক্ষণাত্মক হওয়াটাও যুদ্ধের কৌশলের অঙ্গ।” কার্ল ভিনসনের কম্যান্ডিং অফিসারটি কেমন হুঁশিয়ারির সুরেই বললেন, “বোমা নিয়ে বোমারুরা ফিরে আসছে মানেই আইএস ফুরিয়ে যায়নি। হতেই পারে, ওরা আমাদের নজরের বাইরে, খবরের বাইরে আত্মগোপন করে আছে!”
একটা বিষয়ে মার্কিন সেনাপতিরা একমত অনেক কাজ বাকি। মসুলের মতো শহরকে আইএস-মুক্ত করতে ইরাকি সেনাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাদের অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ আসল কাজটা তো করতে হবে ইরাকি সেনাকেই।
কাজেই জাহাজে দাঁতের ডাক্তারখানায় সাঁটা পোস্টারে আইএস-এর শক্তি নিয়ে যতই মস্করা করা হোক, ওই শত্রুই প্রবল শক্তিধর আমেরিকাকে বিরক্ত করে মারছে।
আক্কেল দাঁতের মতো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy