Advertisement
E-Paper

বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে কাটল দুর্গাপুজো

কোনও শঙ্কা ছাড়াই শেষ হল বিসর্জন। মা চলে গেলেন শিবঠাকুরের ঘরে। বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে শেষ হলো দু্র্গাপুজো। কয়েকমাস আগে পুরোহিত, যাজক পির আর মুক্তমনাদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড যে শঙ্কার মেঘ তৈরি করেছিল, সেই মেঘের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি এবারে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫৫
বাংলাদেশে চলছে বিজয়া উৎসব। —নিজস্ব চিত্র।

বাংলাদেশে চলছে বিজয়া উৎসব। —নিজস্ব চিত্র।

কোনও শঙ্কা ছাড়াই শেষ হল বিসর্জন। মা চলে গেলেন শিবঠাকুরের ঘরে। বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে শেষ হলো দু্র্গাপুজো। কয়েকমাস আগে পুরোহিত, যাজক পির আর মুক্তমনাদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড যে শঙ্কার মেঘ তৈরি করেছিল, সেই মেঘের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি এবারে। বাংলাদেশ জুড়ে ২৯৩৯৫ টি পুজো মণ্ডপ হয়েছিল। গত বছরে এই সংখ্যাটি ছিল ২৯০৭৪। এবার যেমন পুজোর সংখ্যা বেড়েছে, তেমনই এবারে মানুষের ভিড়ও ভেঙে ফেলেছে গত অনেক বছরের রেকর্ড। শহর থেকে গ্রাম, শহরতলি থেকে ঢাকা সমস্ত জায়গায়। এবারের দুর্গাপুজোর দিনগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এই বছরের শুরুর দিকে যখন টার্গেট কিলিং শুরু হল- তখন সারা বাংলাদেশই থমকে গিয়েছিল। গ্রাম এলাকায় ও শহরে পরপর কয়েকজন পুরোহিত হত্যার পরে, বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিমা ভাঙ্গাতে কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিলেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্তু সেই মেঘ কেটে গিয়েছে সাম্প্রতিক একের পরে এক জঙ্গি বিরোধী অভিযানে। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা নাড়া দিয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিকড়ে। আমরা দেখলাম টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, পদ্মা থেকে কর্ণফুলির পাড়ের মানুষদের শিকড়ে ফেরা। দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কী ভাবে একত্র হল। আর তারই ফলাফলে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রের পাহারাদার। একদিনে ৫০ লক্ষ মানুষ হাতে হাত রেখে মানববন্ধন গড়ে রচনা করল নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গতিধারায় ফেরার ইতিহাস। লাইনচ্যুত ট্রেনের নতুন করে লাইনে উঠে যাত্রার ইতিহাস। লাল সবুজের সেই যাত্রায় মানুষেরই জয় হল। জয় হল অসাম্প্রদায়িকতার।

বাংলাদেশে এবারের দুর্গা পুজোর বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথমত, সারাদেশে জঙ্গি দমনে একের পরে এক অভিযান চালানো হলেও দেশ জঙ্গিমুক্ত হয়ে গিয়েছে এমন নয়। নব্য জেএমবির চাঁইদের অনেকে কুপোকাত হলেও তারা একেবারে শক্তিহীন হয়ে এখনও মুখ থুবড়ে পড়েনি। সে ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ২৯৩৯৫ টি মণ্ডপের মধ্যে কয়েকটিতে তাণ্ডব চালানোর ভয় ছিল। আর সে কারণেই আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য এটা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবারের সফলতা এই ক্ষেত্রে শত ভাগ। অন্যদিকে প্রতি বছরের আরেকটি আশঙ্কা থাকে পুজোর আগে প্রতিমা ভাঙার ঘটনার। সেই ঘটনাও এবারে উল্লেখ করার মতোন ঘটেনি। গত বছরের সঙ্গে এ বছরের হিসেব করলেও অনেকটাই সফলতা এসেছে এবারের এই নিয়ন্ত্রণে।

আবার হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলা ১ জুলাইয়ের পর অনেকটাই থমকে দিয়েছিল বাংলাদেশের গতি। পথ ঘাট থেকে শপিংমল সবজায়গাতেই ভয়টা ছিল। কিন্তু কল্যানপুরের জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযানের পর থেকে চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। ফের শুরু হয় মানুষের বুক ভরে শ্বাস নেওয়া। চালু হতে থাকে প্রায় বন্ধ হোটেল রেস্তোরাঁ, সমস্ত বড় শপিং কংপ্লেক্সগুলোও। শুরু হয় অর্থনীতির চাকার স্বাভাবিক ঘোরা।

১ জুলাইয়ের পরে সেই টার্গেট কিলিং এর ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়েছ। সাধু, পুরোহিত, পির হত্যার কারণে যে আতঙ্ক, তার মেঘটাও কেটেছে অনেকটা। আর একই সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড সাধারন মানুষের মনে ফেলেছে অনেকটা বড় প্রভাব। বাঙালি পরিচয়কে প্রধান করে ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে আবারও সামনে এসেছে সেই স্লোগান— ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।

বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদের সাধারন সম্পাদক তাপস কুমার পালের কাছে আনন্দবাজারের প্রশ্ন ছিল, এবারের পুজোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক কী? তিনি বললেন, এবারে পুজোতে বাংলাদেশ অনেকটাই বিদায় দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতাকে। ঢাকা সহ সারা দেশেই মানুষ কোনও ধর্মের ব্র্যাকেটে আটকে না থেকে উৎসবকে আপন করে নিয়েছে। ফলে গত বহু বছরের রীতি ভেঙে এবার মণ্ডপগুলোতে পঞ্চমীর দিন থেকেই মানুষের সমাগম শুরু হয়েছিল। তাপস কুমার সরকার বললেন, সব ধর্মের মানুষ এবারে যেমন আনন্দে সামিল হতে এসেছেন, তেমনই এসেছেন সামাজিক ও মানবিক বন্ধনের বার্তা নিয়ে।

বিজয়া দশমী উপলক্ষে মঙ্গলবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। পুজো উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সমস্ত বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো পুজো উপলক্ষে বিশেষ সাময়িকী প্রকাশ করছে। পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে পুজোর শুভকামনা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সরকারের মন্ত্রী সংসদ সদস্যরা প্রতিবছরের মতো এবারেও বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়েছেন। অভয় জুগিয়েছেন সকলকে।

বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাপস কুমার পাল জানিয়েছেন, এই বছর ঢাকা বিভাগে ৬ হাজার ৩৯৩টি, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৬০১টি, রাজশাহিতে ৩ হাজার ৩১৫টি, খুলনায় ৪ হাজার ৬৩২টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৮৫৪টি, চট্রগ্রাম বিভাগে ৪ হাজার ১৫০টি, রংপুর বিভাগে ৫ হাজার ১০টি, সিলেটে ২ হাজার ৪৪০টি পুজো মণ্ডপসহ সারাদেশে মোট ২৯ হাজার ৩৯৫টি স্থায়ী ও অস্থায়ী মণ্ডপে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এবারে পুজোয় বিভিন্ন মণ্ডপে বিদেশিদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। হলি আর্টিজানে হামলা করে বিদেশিদের হত্যা করে যে ভয় তৈরির চেষ্টা, তা আর নাই। বিদেশিদের উপস্থিতি সেটাই প্রমান করেছে। বাংলাদেশে তার যে অসাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই রূপেরই আবার উত্থান ঘটেছে এ বারের পুজোতে, যা ছিল প্রত্যাশিত। এই মানুষের উৎসব মনে করিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদের রক্তধারাকে। যে রক্তধারার কোনও ধর্ম পরিচয় না, ছিল বাঙ্গালি পরিচয়।

durga pujo Bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy