Advertisement
E-Paper

পিছনে বাবা-ভাইয়ের লাশ, অন্তঃসত্ত্বা সেবু তারার গল্প

সেবুর বয়স মাত্র ১৭। সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডুর পাড়িয়া বিল এলাকায়। চার দিন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছেছে তিন দিন আগে। পথে খাবার জোটেনি। এসেছে বুলেট আর মৃত্যুর হাতছানি পেরিয়ে— কিন্তু এখনও তার আশ্রয় মেলেনি।

অঞ্জন রায়

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৯:১০
ঘরদোর, আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে পালাতে হয়েছে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে। বাংলাদেশে তিনি এখন আশ্রিতা। ভবিষ্যৎ কী, জানা নেই। —নিজস্ব চিত্র।

ঘরদোর, আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে পালাতে হয়েছে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে। বাংলাদেশে তিনি এখন আশ্রিতা। ভবিষ্যৎ কী, জানা নেই। —নিজস্ব চিত্র।

মঙ্গলবারের বিকেল। পশ্চিমের আকাশে সূর্য অনেকটা নুয়ে গেছে। আকাশে নীল-সাদায় মাখামাখি। উখিয়া-টেকনাফ সড়কে চলাচল করছে শ’য়ে শ’য়ে যান। এমন সময়েই দেখা হয় সেবু তারা’র সঙ্গে। ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর নিয়ে পুঁটুলিতে মাথা রেখে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে সেবু। ক্যামরা দেখেই উঠে বসার চেষ্টা করলেন বটে, তবে ব্যর্থ হলেন। ক্লান্ত শরীরে যেন এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই।

সেবুর বয়স মাত্র ১৭। সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডুর পাড়িয়া বিল এলাকায়। চার দিন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছেছে তিন দিন আগে। পথে খাবার জোটেনি। এসেছে বুলেট আর মৃত্যুর হাতছানি পেরিয়ে— কিন্তু এখনও তার আশ্রয় মেলেনি। গতকাল সকালে স্বামী মহম্মদ. ইলিয়াস তাকে নিয়ে বের হন আশ্রয় খুঁজতে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত হাঁটার পর সেবুর পা আর চলছিল না। শরীর ভেঙে আসছিল। অনন্যোপায় হয়ে রাস্তার ধারেই লুটিয়ে পড়েন সেবু। কিন্তু আশ্রয় তো খুঁজে বের করতে হবে। না হলে তো বৃষ্টি-ঝড়ের দুর্ভোগ। সেবুকে রেখেই আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যান স্বামী।

কথা হয় সেবু তারার সঙ্গে। সে জানায়, মংডুর যে এলাকায় তাদের বাড়ি সেখানে গত ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে নির্বিচারে আগুন জ্বালিয়েছে মায়ানমারের সেনারা। আগুনে তাদের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। সহায় সম্পদ লুঠ করেছে সেনাদের সঙ্গে আসা লোকজন। তার শ্বশুরকে গুলি করে হত্যা করেছে তারা। তার পর ওই দিন বিকেলেই অজানা পথের দিকে পা বাড়ায় সেবুর পরিবার। সঙ্গে ছিল গ্রামের আরও জনা ত্রিশেক লোক। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

মায়ানমারের ঘটনা শুনুন সেবু তারার মুখে:

কিছু দূর হেঁটেই অদূরের একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন সবাই। রাতে সেখানে সেনারা আবার হানা দেয়। গুলি চালায়। সেবুর ভাই ইয়াসিদুল-সহ সেখানেই চার জন মারা যায়। তাদের ‘দাফন’ না করেই ভোররাতে আবার বাংলাদেশের দিকে এগোতে থাকে সেবু তারা-রা। তার পর গত চার দিন ধরে মাইলের পর মাইল ফসলের মাঠ, পাহাড়, জঙ্গল, নদী পেরিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভোরে হোয়াইকং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে তারা। এর পর থেকে গত তিন দিনের টানা বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মাঝে অভুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করছেন।

আরও পড়ুন: সমালোচনায় ভীত নই, রোহিঙ্গা সংকটে মুখ খুললেন সু চি

সেবু তারার মতো এ রকম অসংখ্য অন্তঃস্বত্ত্বা নারী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসছেন। পেটে সন্তান নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোয়াতে পোয়াতে উদ্বাস্তু বনে যাচ্ছে সেবু তারা-রা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত চার লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ হারিয়ে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আসছেন অনেক পুরুষ এবং তরুণও।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যে, রাখাইন অঞ্চলে ইতিমধ্যে ২১৪টি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে মংডু ও রাথেডং এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়েছে। প্রদেশটিতে মায়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের জাতিগত ভাবে নির্মূল করছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। মায়ানমার সেনাবাহিনীর উপর কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অবরোধ জারি করার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে আর্জি জানিয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের নিয়ে দিল্লির সুরেই সুর মেলাল ঢাকা

এই পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার মায়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী আউং সান সু চি বলেছেন, রাখাইন প্রদেশ থেকে মুসলিমদের চলে যাওয়ার কারণ তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। এ জন্য সেখানকার মুসলিমদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান।

এক নারীর কথায় আর এক আশ্রয়হীন অন্তঃসত্ত্বা নারী সেবু তারা কি আশ্বস্ত হলেন? কে জানে!

(তথ্য সহায়তা: আজহার মাহমুদ, উখিয়া)

Rohingya Myanmar Bangladesh Sebu Tara সেবু তারা রোহিঙ্গা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy