Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

লগ্নির আগেই তৈরি করুন পরিকল্পনা

চাকরিতে যোগ দিয়েছেন কয়েক মাস হল। লগ্নি শুরু করেননি এখনও। ফলে টাকা পড়ে থাকছে সেভিংসেই। তহবিল গড়ার উপায় বাতলালেন শৈবাল বিশ্বাসযাঁরা সবেমাত্র লগ্নির জগতে পা রাখছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে রিস্ক প্রোফাইলিং করা থাকলে মাপা ঝুঁকি নিয়েও তহবিল তৈরি করা সম্ভব।

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

পরিচিতি: সোহিনী (২৫)

কী করেন: কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। বাবা, মা, বোনের সঙ্গে থাকেন নিজেদের বাড়িতে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। রয়েছে ফ্ল্যাট। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে ও বোন স্কুলে পড়ে

লক্ষ্য: সবিস্তার জানতে চান লগ্নি সম্পর্কে। পাঁছ বছরে

এক বার বিদেশ ভ্রমণ। করতে চান স্বাস্থ্য বিমা

চাকরির দুনিয়ায় কয়েক মাস হল পা রেখেছেন সোহিনী। এখনও পর্যন্ত সঞ্চয় শুরু করেনি। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, সঞ্চয় সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা নেই। ফলে ২৯,০০০ টাকা রোজগার করেও তাঁর কোথাও লগ্নি নেই। নিজের এবং অন্যান্য খরচ বাদে পুরো টাকাটাই পড়ে থাকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে। অথচ বিদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে অবসরের সঞ্চয়, নিজের বিয়ের টাকা জোগাড়ের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। কী ভাবে তা সম্ভব, সেটাই দেখব।

নিট আয় ২৯০০০

খরচ

সব হিসেব টাকায়

ধাপে ধাপে লগ্নি

ভাবলাম আর করে ফেললাম, এ ভাবে আর যা-ই হোক লগ্নি হয় না। তার জন্য বেশ কিছু জিনিস মেনে চলতে হয়। এগোতে হয় ধাপে ধাপে। সংক্ষেপে সেই ধাপগুলি হল—

• স্থির করতে হবে লক্ষ্য।

• ঝুঁকির ক্ষমতা যাচাই জরুরি।

• তৈরি করতে হবে লগ্নির পরিকল্পনা। অর্থাৎ কোন ক্ষেত্রে লগ্নি (যেমন ফান্ড, শেয়ার না ব্যাঙ্কে), বাছাই করতে হবে তা। বাছতে হবে নির্দিষ্ট প্রকল্পও।

• নিয়মিত খতিয়ে দেখতে হবে লগ্নি।

এই ধাপগুলি ধরেই সোহিনীকে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করব।

লক্ষ্য বাছাই

সোহিনীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। অর্থাৎ, তিনি পেনশন পান। কিন্তু তেমনই তাঁকে সংসারের দায়িত্বও নিতে হয়। ফলে পরিবারের লগ্নির মধ্যে তাঁর হিসেবকে ধরছি না। তার বাইরে সোহিনীর হাতে মাস গেলে থাকছে প্রায় ২৩ হাজার টাকা। সেই টাকা লগ্নির জন্য তাঁকে প্রথমেই বাছাই করতে হবে লক্ষ্য। জানতে হবে ঠিক কী চাইছেন তিনি। কোন খাতে খরচের জন্য সঞ্চয় করতে চাইছেন।

লক্ষ্য সাধারণত তিন ধরনের হয়— স্বল্প, মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি। যেমন ধরুন, এক বছরের মধ্যে একটি গাড়ি কেনার কথা ভাবছেন। সেটা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য। কিন্তু যদি বাড়ির কথা ভাবেন, তা সঙ্গে সঙ্গে সম্ভব নয়। অনেক পরিকল্পনা দরকার। অর্থাৎ, সেটা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য।

নিজের চিঠিতে বিয়ের সঞ্চয়, বিদেশে ঘুরতে যাওয়া এবং অবসরের পরিকল্পনার কথা বলেছেন তিনি। এর মধ্যে বিয়ে বা বিদেশে যাওয়া তাঁর মাঝারি মেয়াদের লক্ষ্য। আর অবসরের সঞ্চয় দীর্ঘমেয়াদি। ফলে দুই ক্ষেত্রে লগ্নির ধরনও আলাদা হবে।

ঝুঁকি কতটা নেবেন

কষ্ট করে রোজগার করা টাকা যাতে বেড়ে ওঠে, সে জন্যই আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষ লগ্নি করি। তাই লগ্নি করা অর্থ কমে যেতে পারে জেনে কোনও প্রকল্পে লগ্নি করতে আমরা ভয় পাই। অথচ কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় ঝুঁকি না-নিলে রিটার্ন কম মেলে। তখন পরে গিয়ে মনে হয়, ইস্‌ আর একটু যদি ঝুঁকি নিতে পারতাম ভাল হত। এই কারণে লগ্নির ক্ষেত্রে ঝুঁকির ক্ষমতা যাচাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ঠিক করে দেয় আপনি কোন কোন ক্ষেত্রে টাকা খাটাবেন। অথচ অনেক সময়েই আমরা এটাকে অবহেলা করি। চলুন এক নজরে দেখে নিই ঝুঁকির ক্ষমতা বুঝতে গিয়ে কী কী বিষয় মাথায় রাখা জরুরি।

ঝুঁকি কী: লগ্নির ক্ষেত্রে সোজা কথায় বলতে গেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা জেনেও কোনও প্রকল্পে টাকা ঢালা। অর্থাৎ কি না, সেখানে টাকা রাখলে তা ডুবতে পারে জেনেও এগিয়ে যাওয়া।

ঝুঁকির মাত্রা: প্রত্যেকের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা আলাদা। লগ্নিকারীর পারিপার্শ্বিক অবস্থাই ঠিক করে দেয় তার মাত্রা কতটা হবে। যে পদ্ধতিতে কারও ঝুঁকির মাত্রা ঠিক করা হয়, তাকে বলে রিস্ক প্রোফাইলিং।

সুবিধা কোথায়: যাঁরা সবেমাত্র লগ্নির জগতে পা রাখছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে রিস্ক প্রোফাইলিং করা থাকলে মাপা ঝুঁকি নিয়েও তহবিল তৈরি করা সম্ভব। নিজের ঝুঁকির দৌড় জানা থাকলে, প্রয়োজনে তা বদলানোও যায়। এতে সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরিও থাকা যায়। সোহিনীর ক্ষেত্রে বলতে পারি তাঁর বয়স তিরিশের মধ্যে। বিয়ে হয়নি এখনও। ফলে এটাই আসল সময় ঝুঁকি নেওয়ার।

পরিকল্পনা তৈরি

এ বারের ধাপ হল পরিকল্পনা তৈরি। অর্থাৎ, কোন ক্ষেত্রে টাকা রাখবেন, সেটা বুঝে নিতে হবে এই ধাপে এসে। সোহিনীর বয়স ২৫ বছর। সে ক্ষেত্রে ২০,০০০ টাকার অন্তত ৩০% (৬,০০০ টাকা) শেয়ার ও ৫০% বা ১০,০০০ টাকা শেয়ার ভিত্তিক (ইকুইটি) ফান্ডে রাখার কথা বলব। আর বাকি টাকা রাখতে হবে কম ঝুঁকির ব্যাঙ্ক আমানত, পিপিএফ ইত্যাদি প্রকল্পে।

• এটা ঠিক যে সোহিনীর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ফলে প্রথমেই শেয়ারে সরাসরি টাকা রাখতে সচ্ছন্দ না-হওয়াই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁকে প্রথমে ফান্ড চালু করতে হবে। সেখানেই চাইলে ১৫,০০০ টাকা রাখতে পারেন। পরে শেয়ার নিয়ে পড়াশোনা করে সরাসরি সেখানে লগ্নি করতে পারবেন। প্রথমে অবশ্যই ফান্ড বাছাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। পরে অভিজ্ঞতা তৈরি হলে সরাসরি লগ্নির কথা (ডিরেক্ট প্ল্যান) ভাবতে পারেন। কিন্তু শুরুতেই সেই ঝুঁকি নেবেন না।

যদি ধরে নিই সোহিনী ৩০ বছর ধরে মাসে ১০,০০০ টাকা করে ইকুইটি ফান্ডে এসআইপি করছেন। সে ক্ষেত্রে ১২% রিটার্ন ধরলে তাঁর ৫৫ বছর বয়সে গিয়ে তহবিল জমবে প্রায় ৩.০৮ কোটি টাকা। যদি ১৫,০০০ টাকা করে রাখেন, সে ক্ষেত্রে জমবে আরও বেশি।

• হাতে থাকা বাদবাকি ৫,০০০ টাকা রাখতে হবে পিপিএফে। প্রতি বছর এখানে ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা টাকায় করছাড় মেলে। আবার মেয়াদ শেষে (১৫ বছর) হাতে আসা টাকার পুরোটাই করমুক্ত। সে দিক থেকে দেখলে মোটা তহবিল গড়ার সুযোগ রয়েছে এর হাত ধরে।

• চেষ্টা করতে হবে অন্তত তিন-চার মাসের বেতন সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখার। সোহিনী চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে পুরো টাকাই সেভিংসে থাকে। সেই টাকা থাকুক। কারণ, আপৎকালে তা কাজে লাগবে। যে লগ্নির কথা বললাম, সেটা চলতি মাসের বেতন থেকে শুরু করতে হবে।

• এ ছাড়াও অবসরের জন্য পিএফের টাকাও কাজে লাগবে তাঁর।

• নিজের জন্য স্বাস্থ্য বিমা করানোর কথা ভাবছেন সোহিনী। সেটা অবশ্যই ভাল। কারণ বেশির ভাগ বিমা সংস্থাই ২৫ বছরের পরে সন্তানদের ফ্যামিলি ফ্লোটার বিমায় থাকতে দেয় না। ফলে নিজের জন্য কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকার বিমা কিনতে হবে তাঁকে। এ জন্য প্রকল্প ভাল করে খতিয়ে দেখে নিতে হবে। দেখতে হবে যাতে কোনও রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অঙ্ক বলা না-থাকে।

বিয়ের সঞ্চয়

আগামী দু’বছরে বিয়ের কোনও পরিকল্পনা নেই বলে চিঠিতে লিখেছেন সোহিনী। আবার এটাও জানিয়েছেন যে, বিয়ের সব খরচ নিজেই দিতে চান। এ জন্য তাঁর হাতে বাদবাকি যে ৩,০০০ টাকা থাকে, সেটাই জমাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেছে নিতে পারেন লিকুইড ফান্ড। এই ফান্ডে ঝুঁকি অন্যান্য ফান্ডের তুলনায় কম। আর একেবারেই যদি ঝুঁকি পছন্দ না-হয়, তা হলে বেছে নিতে পারেন রেকারিং ডিপোজিট। তবে মনে রাখবেন, এই দুই প্রকল্পেই কিন্তু হাতে আসা মুনাফায় কর দিতে হবে।

বিদেশে বেড়ানো

চিঠিতে পাঁচ বছরে এক বার বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার কথা লিখেছেন সোহিনী। এ জন্য বিয়ের পরে ওই ৩,০০০ টাকা আবার লিকুইড ফান্ড বা রেকারিংয়ে জমাতে হবে। সেটা দিয়েই ঘোরার টাকা জোগাড় হবে।

খতিয়ে দেখা

চারপাশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে লগ্নি পরিকল্পনা বদলে যায়। সোহিনীর ক্ষেত্রেও হবে। বিশেষত বিয়ের পরে তাঁকে পুরোটাই ফের খতিয়ে দেখতে হবে। সেই অনুসারে লগ্নি বদলাতেও হতে পারে। তবে কোনও ক্ষেত্রেই তাড়াহুড়ো করতে বারণ করব। কারণ, চটজলদি নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জেরে ভোগার বদলে ধীরেসুস্থে নেওয়া ঠিক সিদ্ধান্ত কিন্তু লগ্নিকে গতি দিতে পারে অনেকটাই।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investment Banking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE