Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

উৎসবেও সঞ্চয়ী

পুজোর ঢাকে কাঠি পড়েছে। হাতছানি দিচ্ছে দেদার আড্ডা আর ব্যাগভর্তি কেনাকাটা। চুটিয়ে মজা করুন। কিন্তু কাঁচি চালান বাজে খরচে। বিন্দু থেকে সিন্ধুর কথা মনে করালেন অমিতাভ গুহ সরকারকেউ আগে থেকে জমিয়ে, কেউ আয় বাড়িয়ে, কেউ বা অফিসের দেওয়া বোনাসের ভরসায় সেই ইচ্ছের ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু সমস্যা হল, এমন করতে গিয়ে অজান্তে বহু অপচয়ও হবে। যা সতর্ক ভাবে এড়াতে পারলে কিন্তু ম্যাজিক হতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

পুজোর গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে হাওয়ায়। আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, কেনা-কাটা, দেওয়া-থোওয়া, বেড়ানোর হাজারো পরিকল্পনা নিয়ে উৎসবের এই ভরা মরসুম চলবে ডিসেম্বরের বড়দিন পর্যন্ত। খরচ হবে বিস্তর। তবু মনে উঁকি দেবে আরও অনেক মজা লুটেপুটে নেওয়ার দেদার ইচ্ছে। তা সে পকেটের রেস্ত যা-ই হোক না কেন। কেউ আগে থেকে জমিয়ে, কেউ আয় বাড়িয়ে, কেউ বা অফিসের দেওয়া বোনাসের ভরসায় সেই ইচ্ছের ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু সমস্যা হল, এমন করতে গিয়ে অজান্তে বহু অপচয়ও হবে। যা সতর্ক ভাবে এড়াতে পারলে কিন্তু ম্যাজিক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পকেট পুরো ফাঁকা হবে না। আনন্দে রাশ না-টেনেও উৎসব উদ্‌যাপনে মশগুল থাকতে পারবেন। অথচ দেখা দেবে বড় মাপের তহবিল তৈরির সম্ভাবনা। কী করে? চলুন দেখি।

ভরে থাকুক ভাঁড়ার

দুর্গাপুজো শেষ হলে লক্ষ্মীপুজো সেরে বাকিরা দৈনন্দিন সংসার খরচ, কেনা-কাটায় কাঁচি চালাতে শুরু করবেন। আর আপনি ছুটি ফুরোনোর আগে চুটিয়ে সিনেমা দেখবেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন পুরোদমে। কালীপুজো-ভাইফোঁটার কেনা-কাটা সারতে একটুও বেগ পেতে হবে না। ডিসেম্বরের বেড়ানোর ছকও কষে ফেলবেন। এমনটা কি হতে পারে? আমার মতে, খুব কঠিন নয় এটা করা।

ধরুন, উৎসবের বাজেট থেকে ১০% সরিয়ে রাখলেন। না, আনন্দে কাটছাঁট করতে হবে না। শুধু বাদ দিন অপচয়গুলোকে। এড়ান অনাবশ্যক খরচ। এতেই অনায়াসে ১০% টাকা বেঁচে যেতে পারে। দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কী উপায়ে হতে পারে এই সাশ্রয়—

• শুধু নামী ব্র্যান্ডের পিছনে না-ছুটে ছোট ব্র্যান্ড বা ব্র্যান্ডহীন জামাকাপড়ও কিনুন। সময় নিয়ে বাছাবাছি করে কিনলে পছন্দের জিনিস পাওয়া যায়।

• বিভিন্ন দোকানে যে ছাড় দেয়, তার সদ্ব্যবহার করতে পারলে ভাল হয়।

• অনাবশ্যক এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু কেনা থেকে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করুন।

• খুব অপচয় হয় রেস্তোরাঁয়। হুজুগে পড়ে না-খেতে পারলেও একগাদা অর্ডার দিয়ে পরে পস্তান অনেকে। বরং শুরু থেকেই ভাবুন কী ভাবে অর্ডার দিলে খাওয়া ভাল হবে, অথচ টাকা নষ্ট হবে না।

• অনেক বাজি সুন্দর হলেও দাম আকাশছোঁয়া। ঝোঁকের বশে তাতে অত্যধিক টাকা ছাই হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বরং দঙ্গল বেঁধে পোড়ালে সাধারণ বাজির মজাও দশগুণ বাড়ে।

• লোক দেখানো নয়, খরচ করুন নিজের প্রয়োজন এবং আনন্দের জন্য।

• আজকাল বিমান টিকিটে নানা সময়ে ছাড় পাওয়া যায়। কোথাও বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকলে আগে থেকে কম দামে টিকিট কেটে রাখুন।

• যা-ই করুন, আগে বাজেট বানান। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে খরচ করুন। বাজেটের মধ্যেই থাকুন।

• যে-খরচ পরে করলেও চলে, তা পরের জন্যই তুলে রেখে দিন।

• ধার নৈব নৈব চ। কেনা-কাটাই হোক বা বেড়ানো, ঝোঁকের মাথায় ধার করে টাকা জোগাড় মানে ডুবলেন।

মুষ্টি তোলা

আগেকার দিনে একটা চল ছিল, মা-ঠাকুরমারা পরিবারের প্রতিবেলার রান্নার চাল থেকে আলাদা একটি পাত্রে একমুঠো করে সরিয়ে রাখতেন। এই রেওয়াজকে বলা হত ‘মুষ্টি তোলা’। এই ভাবে অল্প অল্প করে চাল সরানোয় কারও কিন্তু ভাতে কম পড়ত না। অথচ এই পথে হেঁটে একটু একটু করে জমে উঠত অনেকখানি চাল, যা দুর্যোগের দিনে দারুণ ভাবে কাজে লাগানো যেত। এই একই পন্থা নিয়ে উৎসবের বাজেট থেকে একমুঠো সরিয়ে রাখলেও মোটেই তা কারও গায়ে লাগবে না। এ বার প্রশ্ন হল, কোন উপকারে আসবে এই ‘একমুঠো’? চলুন দেখি।

পুজোয় লগ্নি

ধনতেরসে সোনা, রুপোর মতো দামি ধাতু কেনার রেওয়াজ পালন করেন অনেকে। যা এখন ঢুকে পড়েছে বাঙালি সমাজেও। উত্তর-পশ্চিম ভারতের মানুষেরা আবার দেওয়ালির সন্ধ্যায় শেয়ার কেনাকে শুভ মানেন। যে-কারণে দিনটি ছুটির হলেও, সন্ধ্যায় শেয়ার বাজারে বসে বিশেষ লেনদেন, মুহরত লেনদেন পর্ব। এই ব্যাপারটিও যদি বাঙালি সমাজে ঢুকে পড়ে, তবে মন্দ কী! সুতরাং—

• উৎসবের পুরো মরসুমে যা সাশ্রয় হল, তা দিয়েই কেনা যেতে পারে গুটিকতক ভাল শেয়ার।

• প্রতি বছর একটি করে স্বর্ণমুদ্রা না কিনে যদি সেনসেক্সের অন্তর্ভুক্ত তিনটি করে শেয়ার কেনা যায়, তবে ১০ বছরের মধ্যে সূচকটির আওতায় থাকা সবক’টি সংস্থার শেয়ার (৩০টি) এসে যাবে হাতের মুঠোয়। ১০ বছরে সেনসেক্স নিশ্চয়ই অনেকটাই এগোবে। কারণ গত ১১ বছরে তা ১০ হাজার থেকে উঠে এসেছে ৩২ হাজারে। অর্থাৎ সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকবে আপনার সমৃদ্ধি।

• কোনও শেয়ারে লগ্নি করলে অনেক সময় সেই সংস্থার পণ্যের উপরে পাওয়া যায় আকর্ষণীয় ডিসকাউন্টও। একটি উদাহরণ দিয়ে বলছি বিষয়টি। উল্লেখ্য, এই লেখায় কোনও সংস্থার নাম বলা না-হলেও, ব্যবহৃত উদাহরণের কোনওটিই কাল্পনিক নয়। যেমন, একটি জুতো সংস্থা তাদের শেয়ার কিনলে বছরে দু’টি করে ২০% ডিসকাউন্ট কুপন দেয়। অর্থাৎ সংস্থা থেকে ১৫০০ টাকার জুতো কিনলে সাশ্রয় হতে পারে ৬০০ টাকা। এক ঢিলে এ ভাবে দুটি পাখি মারা মন্দ নয়।

• কোনও কোনও এনবিএফসি তাদের জমা প্রকল্পে কোম্পানির সদস্যদের সুদ দেয় অতিরিক্ত ০.২৫%।

সত্যিই কি লাভ?

প্রশ্ন উঠতে পারে, পুজোর বাজেট থেকে কতটাই বা সাশ্রয় করা যাবে? এবং ওই সামান্য টাকা লগ্নির ভবিষ্যৎই বা কী!

ধরুন, ১০% সাশ্রয়ের লক্ষ্য বেঁধে এগোনো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যাঁর বাজেট ১০ হাজার, তিনি সাশ্রয় করবেন ১,০০০ টাকা। যাঁর ১ লক্ষ টাকা, তাঁর প্রায় ১০,০০০ টাকা। আপনি হয়তো ভাবছেন, হাজার টাকা বাঁচিয়ে কী লাভ! আজকাল কী মূল্য আছে তার! কিন্তু আমি বলব, মাত্র ১,০০০ টাকা লগ্নির এমন তহবিল তৈরির ক্ষমতা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে অনেক উৎসবে অঢেল টাকার জোগান দিতে পারবে।

বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮৮ সালে একটি মোটরবাইক সংস্থার রাইটস ইস্যুতে ১০০টি শেয়ারে যিনি ১,০০০ টাকা লগ্নি করেছিলেন, তার বর্তমান মূল্য ৫০ লক্ষ টাকা। এমন ঘটনা আরও আছে। বলছি না সব লগ্নিই এমন বাড়বে। সেই আশা করা ঠিকও নয়। তবে ভাল শেয়ারে ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরলে বহু ক্ষেত্রেই বড় রুই-কাতলা ওঠে।

ছ’হাজারে নতুন গাড়ি

শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবে এটা হয়েছে। একটি গাড়ি সংস্থার আইপিও লগ্নিকারীদের মাত্র ৬ হাজারে গাড়ি কেনার স্বপ্ন সফলের পথ দেখিয়েছে। ২০০৩ সালে ১২৫ টাকা দামে বাজারে শেয়ার ছেড়েছিল তারা। ছোট লগ্নিকারীদের প্রায় সবাই পেয়েছিলেন ৫০টি করে শেয়ার। অর্থাৎ মোট লগ্নি করতে হয়েছিল মাত্র ৬,২৫০ টাকা। এখন সেই সংস্থারই প্রতিটি শেয়ারের দাম ৭,৮০০ টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ৫০টি শেয়ার বেচলে পাওয়া যেতে পারে ৩.৯০ লক্ষ টাকা। যা দিয়ে অনায়াসে কেনা যায় ভাল মানের ছোট গাড়ি। এই সমস্ত উদাহরণই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, লগ্নি ছোট হলেও তা সঠিক জায়গায় হতে হবে। তবেই তা লম্বা মেয়াদে গ়ড়ে দিতে পারে বড় সম্পদ।

অন্য কোথাও

শেয়ার যত বড় লাভেরই লোভ দেখাক, এই লগ্নিতে ঝুঁকিও বেশি। যে-কারণে দেশের মাত্র ৩% মানুষ পুঁজি ঢালেন এখানে। অথচ ব্যাঙ্ক-ডাকঘরে সুদ কমতে থাকায় অনেকেই বিকল্প লগ্নির পথ খুঁজছেন। চলুন দেখি পুজোয় বাঁচানো টাকা কাজে লাগানোর আর কি পথ খোলা রয়েছে—

• তুলনায় কম ঝুঁকিতে ভাল লাভের দরজা খুলেছে মিউচুয়াল ফান্ড। গত এক বছরে হু-হু করে লগ্নি বেড়েছে এতে। দেশে মোট লগ্নি পৌঁছে গিয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকায়।

• শেয়ারের মতো চমকপ্রদ না-হলেও রিটার্নের দিক থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই কিছু ইকুইটি ফান্ড।

দু’একটি বাস্তব উদাহরণ নেওয়া যাক। পুজোর বাজেট কিছুটা ছেঁটে বরুণবাবু (কাল্পনিক নাম) ১৯৯৪ সালে ২,০০০ টাকায় কেনেন ফান্ড-ক। তার পরে ভুলেও গিয়েছিলেন কিছু দিন পরে। সম্প্রতি পুরনো কাগজের স্তূপে পাওয়া গেল এই লগ্নির তথ্য। ন্যাভ দেখে চক্ষু চড়কগাছ! ওই ২০০০ টাকার বর্তমান মূল্য ১,১০,০০০ টাকা। বিক্রি করলে পুরোটাই করমুক্ত। এই ধরনের উদাহরণ আকছার পাওয়া যাবে মিউচুয়াল ফান্ডে।

১৯৯৫ সালে ১০ টাকায় ইউনিট বাজারে ছেড়েছিল ফান্ড-খ। বর্তমানে তার ন্যাভ ১,১০০ টাকা। অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে এতে যাঁরা ১,০০০ টাকা লগ্নি করেছিলেন, তার মূল্য এখন ১,১০,০০০ টাকা, অর্থাৎ ২২ বছরে ১১০ গুণ!

কাজেই দেখা যাচ্ছে, লগ্নি নামমাত্র হলেও বড় মেয়াদে তা বিরাট আকার নিতে পারে। আর উৎসবের মরসুমেই এই রকম ছোট ছোট লগ্নির সুযোগ নেওয়া যায়। তেমন গায়ে লাগবে না, কিন্তু গড়ে উঠবে বড় সম্পদ। যা পরের বছরগুলিকে আরও আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলবে। তা হলে আর বসে থাকা কেন! মাঠে নেমে পড়া যাক এ বছর থেকেই। ঢাকে কাঠি পড়া থেকেই শুরু হোক লগ্নির তৎপরতা। পুজোর নিয়মের মতোই বেছে নেওয়া যাক একটি বিশেষ দিন— যেমন, সপ্তমী, ধনতেরস, দেওয়ালি বা লক্ষ্মীপুজো। এই সব দিনে শেয়ার বাজার খোলা থাকে। আর লগ্নি তো করা যায় অনলাইনে অথবা মাত্র একটি ফোন কলেই। অতএব এ বারই নতুন পথে পা বাড়ান। উৎসবের মরসুমে লক্ষ্মীর দুয়ার খুলে দেবীকে আহ্বান জানান।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE