—প্রতীকী ছবি।
প্রাক বাজেটে কর কতটা কমতে পারে তাতেই আকণ্ঠ ডুবে আমজনতা। সেটা যে অস্বাভাবিক তাও নয়। বরং সেটাই তো স্বাভাবিক। আবার এটাও ঠিক যে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশ আয়কর দিয়ে থাকেন। দেশের সবাইকে ধরলে আয়কর দেন জনসংখ্যার মাত্র ৪.৮ শতাংশ। আর অঙ্কটা আরও মাথা ঘুরিয়ে দেয় যখন দেখি কোষাগারে আয়কর বাবদ আয়ের ৭৬ শতাংশ আসে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মাত্র ০.৩ শতাংশের পকেট থেকে।
এটা যদি দেশের আর্থিক বৈষম্যের কথা হয়, তা হলেও সেটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ, ঋণ বাদ দিয়ে কেন্দ্রের রাজস্ব আদায়ের অঙ্কটা হল ২৭ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। অন্তত চলতি আর্থিক বছরে অর্থমন্ত্রী যা আয় করবেন বলেছিলেন তার হিসাবটা এ রকমই। আর এর একটা বড় অংশই আসে আয়কর থেকে। তার ৭৬ শতাংশই যদি আসে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ০.৩ শতাংশ নাগরিকের পকেট থেকে তা হলে তো দেশের বৈষম্য নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়।
আর এটা যে মিথ্যা ভাবনা নয় তা কেন্দ্রও জানে। আগামী আর্থিক বছর ভোটের বছর। তাই প্রচারের আলোয় অন্য সব কিছুর সঙ্গে আর্থিক সাফল্যের দাবিটাও স্বাভাবিক। আর এ বারের লড়াইটাও বোধহয় অন্যরকম। তাই অন্য বছরের মতো এই বছরও আর্থিক সাফল্য নিয়ে নানান অতিকথনের সমর্থনে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক দেশের গত ১০ বছরের আর্থিক পরিস্থিতির একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। আর এই সমীক্ষাতেও কিন্তু আমাদের দেশের উন্নয়নের এবং সম্পদের বণ্টনকে আরও সুষম করে তোলার পথে পরিকাঠামো যে কতটা অন্তরায় তার উল্লেখ থাকলেও তার সমাধানের কোনও বিশ্বাস্য পথ চোখে পড়ছে না।
আর তাই এই সমীক্ষা আমাদের একটা ধারণা দেয় শুধু অর্থনীতির কিছু সমস্যা নিয়ে নয়, বলে দিতে পারে সেই সমস্যার কথাও যা উন্নয়নের পথে কঠিন কাঁটা হয়েই থাকতে পারে। কী ভাবে তা দেখতে চোখ রাখা যাক সমীক্ষা কী বলছে তা নিয়ে। এই সমীক্ষা সময়ের নিরিখে দুই ভাগে ভাগ করা। এই দুই ভাগের ভিত্তি কী তা কাউকে বলে দিতে হবে না। বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত অন্য সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে আর্থিক অগ্রগতির তুলনা। আমরা এটার মধ্যে এই আলোচনায় ঢুকব না।
এই সমীক্ষার শুরুই হয়েছে আর্থিক বৃদ্ধির একটা সংখ্যা দিয়ে— সাত শতাংশ। বলা হয়েছে এই হার যদি দিনের আলো দেখে তা হলে পর পর চার বছর ভারত এই বৃদ্ধির হার অর্জন করবে। এই চার বছরের প্রথম দুই যে কোভিডের কারণে প্রায় বসে যাওয়া অর্থনীতি থেকে আলোয় ফেরার হাঁটার গল্প তা আমরা জানি।
কিন্তু যা উল্লেখযোগ্য তা হলে আগামীর দিশা হিসাবে এই সমীক্ষা কী বলছে। আমরা ইতিমধ্যেই বিশেষ করে তথাকথিত বিশ্বায়নে প্রেক্ষিতে দু’টি প্রবণতা লক্ষ করছি। এক তো হল উৎপাদন শিল্পে চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর প্রচেষ্টা। আর অন্যটি অতি সাম্প্রতিক লোহিত সাগরে হাউতি বা হুতি জলদস্যুর আক্রমণ। ওই অঞ্চলে আগে ছিল সোমালি জলদস্যুদের চাপ আর তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে হুতিদের উৎপাত। এই সমীক্ষাতে এর উল্লেখও আছে। এবং তা এসেছে বিশ্বায়নের উল্টোদিকে হাঁটা শুরু হওয়ার প্রবণতা দেখেই। আর এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ভারতের সুবিধার কথা।
এটা ঠিকই যে বিশ্বায়নের ফলে যে ভাবে চিন গোটা বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, ভারতের মতো দেশ হয়ে উঠেছিল তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে মানবসম্পদ সরবরাহকারী দেশ এবং অন্যরা অন্য ক্ষেত্রে তার পরিপ্রেক্ষিতে রাতারাতি বিশ্বায়নের এই জটিল সরবরাহ শৃঙ্খল রাতারাতি ছিঁড়ে যে যার ঘরে সব কিছু গুটিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক হিংসার ঝুঁকি এড়াতে বিশ্বের তাবড় সংস্থা চাইবে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বিভিন্ন দেশে এমন ভাবে ছড়িয়ে দিতে যাতে কোনও দেশের রাজনৈতিক ঝামেলা তাদের ব্যবসার উপর বিরাট কোনও প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
আর এইখানেই যে ভারত তার সুযোগ খুঁজছে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও দিনই কোনও রাখঢাক করেনি। এবং এটা স্বাভাবিক। এই সমীক্ষাও সেই রাস্তায় হেঁটে সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছে। এবং বলেছে এটাই সুযোগ। কিন্তু এই পথে হাঁটতে গেলে যে সংখ্যক প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ প্রয়োজন তা তৈরি করতে আমরা কি পদক্ষেপ করতে পেরেছি?
এ ব্যাপারে সংশয়ের অবকাশ তো আছেই এবং সে সংশয় যে কল্পসংশয় তাও নয়। আমাদের দেশে সাধারণের সাধ্যের মধ্যে ভাল স্কুল পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই মেধার নিক্তিতে স্কুলের প্রতি ক্লাসে সেই ক্লাসের উপযোগী শিক্ষা পাচ্ছে না পড়ুয়ারা। সাধারণ অঙ্ক বা সহজ বইও পড়ে উঠতে পারছে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররাও। এ তথ্য বহু আলোচিত। কিন্তু এখানে যদি মাথায় রাখি সম্পদ তখনই উৎপাদনশীল যখন সে উৎপাদনে দক্ষ তখনই আমরা কিন্তু বুঝতে পারি এর গুরুত্ব। যে নাগরিক কার্যকরী অর্থে নিরক্ষর তার পক্ষে কিন্তু কায়িক শ্রমকেই আয়ের সূত্র হিসাবে আঁকড়ে থাকতে হয়। আর এটাও কিন্তু আমাদের দেশে আয়ের পুনর্বণ্টনের পক্ষে অন্যতম কাঁটা হয়ে ওঠে।
যেটা উল্লেখ্য তা হল, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের ৭০০ কোটি ডলারের অর্থনীতির বহর তৈরির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা। এর সঙ্গে আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে চোখ রাখা যাক। আমাদের ২০২০ সালের শিক্ষানীতি বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এমন মানবসম্পদ তৈরিতে মন দিতে হবে যাতে শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষার দরজা খোলা থাকে। খেয়াল করে দেখলে বুঝব ২০৩০ সালকেই আমরা বেছে নিয়েছি আমাদের সেই বিরাট লাফের জন্য। এখানে শুধু একটা কথাই মনে রাখা জরুরি যে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের মানের উপর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে গিয়েছে, স্কুলগুলোর অবস্থা তথৈবচ এবং সন্তানের জন্য ভাল শিক্ষার ব্যবস্থা তাঁরাই করাতে পারছেন যাঁদের টাঁকের জোর আছে। আর তাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সন্তানের মেধা নিরপেক্ষে যে নিজেকে গড়ে তোলার যে সুযোগ পাচ্ছে তা সাধারণ ঘরে অমিল। কাজারে বাজারেও তাই লড়াইয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে সাধারণ ঘরের সন্তানরা।
গোড়াতেই আমরা দেখেছি আয়কর দেন দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মাত্র ৬.৩ শতাংশ। তার মানে সন্তানকে ভাল শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী আর্থিক সঙ্কুলান ১৪০ কোটির দেশ কত জন অভিভাবকের আছে তা বুঝতে আমাদের কম্পিউটারের প্রয়োজন পড়ে না। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিসংখ্যানটা মিলিয়ে নিলেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনীতির বহর বাড়িয়ে ৭০০ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে গেলে প্রয়োজন বিপুল প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ। প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন শিল্পে এমনকি ঘর পরিষ্কার করতেও পুরনো কায়িক ‘ঝাঁটা’র ব্যবহারের কথা ভাবাই যায় না। তাই প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শ্রমিকের। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করেও এক পাতা পড়ে মানে করতে না পারা মানবসম্পদে এই চাহিদা মেটে না। চাই এমন শ্রমিক যে সাধারণ লিখিত নির্দেশ পড়ে মানে বুঝতে পারে। আর এটার অভাব যে নীতি নির্ধারকদের চিন্তায় রেখেছে তা এই আর্থিক সমীক্ষাতেও স্পষ্ট।
সমীক্ষা বলছে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে প্রয়োজন বয়সোচিত শিক্ষার ব্যবস্থা এবং সেই শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ যাতে সবাই পায় ও তা কার্যকরী হয় তার প্রতি নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী দিনের উন্নয়নের এটাই হবে অন্যতম নির্ধারক।
এটা আমরা জানি। কিন্তু এও জানি যে যাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় উৎপাদনের ৬ শতাংশ বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের লক্ষ্য এখনও অধরাই রয়ে গিয়েছে। উল্টে আইআইটি-র মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ সাধারণের হাতের বাইরে। তাই এখানেও মেধার থেকে অভিভাবকের বিত্তই মূল নির্ণায়ক হয়ে উঠছে শিক্ষার অধিকারের।
এটা সরকারও জানে। তাই এই সমীক্ষায় শিক্ষাকে টেকসই বৃদ্ধির অন্যতম শর্ত হিসাবে মেনে কেন্দ্রের আর্থিক উপদেষ্টা অনন্ত নাগেশ্বরণ বলতে বাধ্য হন যে আজ ভারতের অনেক তরুণ নাগরিকই আরও ভাল জীবনের স্বপ্নই শুধু দেখেন না, সেই জীবন যে তাঁদের হবেই সে ব্যাপারেও তাঁরা নিশ্চিত।
নাগেশ্বরণ জানেন বৈষম্যের কথা। তাই তিনি এই সমীক্ষায় তাঁর মুখবন্ধে ‘সবাই’ না লিখে ‘অনেক’ লেখেন। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের শর্ত পূরণ না হলে তো ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে। আশা একটাই ২০৩০ এখনও ছয় বছর দুরে!
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল আসলে দেখা উচিত শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ এই সব সমীক্ষার কথা মেনে টেকসই উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে কিনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy