কথা: গভর্নর হিসেবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শক্তিকান্ত দাস। এএফপি
উর্জিত পটেল সরে দাঁড়ানোর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নাম ঘোষণা। তার এক দিনের মধ্যে সাংবাদিক সম্মেলন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২৫তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই যাবতীয় প্রশ্নের জন্য দরজা খুলে দিলেন শক্তিকান্ত দাস। ওই পদে থাকাকালীন উর্জিত যা সচরাচর করেননি। কিন্তু শিল্প মহল, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমজনতা—সকলেই বলছেন, নতুন গভর্নরের সমস্ত জবাব, প্রতিশ্রুতির পরেও জেগে রইল আসল প্রশ্নটাই। তা হল, কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টার সামনে কি শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবেন এই পোড়খাওয়া আমলা?
ডলারের চড়া দাম থেকে অনুৎপাদক সম্পদ— শীর্ষ ব্যাঙ্কের মসনদে বসে অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখেই হয়তো পড়তে হবে শক্তিকান্তকে। কিন্তু সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ সম্ভবত কেন্দ্রের সামনে মাথা না-নুইয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা রক্ষা করা। কারণ, একই সঙ্গে রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় রাখতে হবে তাঁকে। কার্যত দড়ির উপর হাঁটতে হবে সুদ ঠিক করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে দর কষাকষিতে।
গভর্নর হিসেবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বুধবার শক্তিকান্ত বলেছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা রক্ষায় তিনি দায়বদ্ধ। জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা। কিন্তু একই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন কেন্দ্রের গুরুত্ব এবং তাদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখার বিষয়টি। মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি জোর দিয়েছেন ‘বৃদ্ধি’ শব্দটিতে। যা এই মুহূর্তে কেন্দ্রের একান্ত পছন্দের। বিশেষত ভোটের মুখে অর্থনীতির চাকা কিছুটা বসে যাওয়ার এই সময়ে। এই জটিল পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতির চাপ কতটা এড়াতে পারেন, সে দিকে তাই নজর থাকবেই। বার বার তাঁকে হয়তো তুলনা করা হবে প্রাক্তন আমলা-গভর্নর ডি সুব্বারাওয়ের সঙ্গে। যিনি ইউপিএ জমানায় অর্থ মন্ত্রকের প্রবল চাপ সত্ত্বেও সুদ কমাতে রাজি হননি।
সামনে চ্যালেঞ্জ
• ভাঁড়ারের ভাগ: রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে থাকা বিপুল সম্পদের (প্রায় ৯.৬ লক্ষ কোটি টাকা) একটা ভাগ সরকারি কোষাগারে আসা উচিত বলে মনে করে কেন্দ্র। এ জন্য এই সম্পত্তি ভাগাভাগির নিয়মে সংশোধন চায় তারা। অনেকের আশঙ্কা, ভোটের মুখে ওই টাকা খরচ হতে পারে খয়রাতিতে। বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্পের জেরে মাত্রা ছাড়ানো রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিতেও। এত দিন এই দাবি মানেনি শীর্ষ ব্যাঙ্ক। জানিয়েছে ওই টাকা কাজে লাগবে অর্থনীতিতে আচমকা আসা ঝড়ঝাপটা সামাল দিতে। এ বার?
• অনাদায়ি ঋণ: বিপুল অনাদায়ি ঋণের বোঝায় এমনিতেই ধুঁকছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। এখন শোনা যাচ্ছে কৃষকের মন জিততে ঋণ মকুবের কথা। ইতিমধ্যেই নাকি এ নিয়ে কথা শুরু হয়েছে সরকারে। সম্ভব হবে বাঁধ দেওয়া?
• ঢালাও ধার: ভোটের মুখে অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে কেন্দ্র চায়, ধারের জোগান বাড়ুক। কিন্তু অনুৎপাদক সম্পদে জেরবার ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের
উপরে নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ (পিসিএ) আরোপ করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কেন্দ্র চায়, তার কিছু অন্তত শিথিল হোক। উর্জিত পটেল অনড় ছিলেন। নতুন গভর্নর?
• বাসেল বিধি: প্রতি ১০০ টাকা ধার দিতে যত মূলধন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে ঘরে রাখতে হয়, তাকে বলে ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েশি রেশিও। কেন্দ্রের মতে, বাসেল-৩ বিধি অনুযায়ী তা ৮% থাকলেই চলে। এ দেশে যা ৯%। ফলে বাড়তি টাকা আটকে থাকায় ধার দিতে পারছে না ব্যাঙ্কগুলি। তা কমানোর বন্দোবস্ত করুক শীর্ষ ব্যাঙ্ক। আগের জমানায় হয়নি। এখন?
• এনবিএফসি: সরকারের দাবি, আইএল অ্যান্ড এফএস কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোখা জরুরি। ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি (এনবিএফসি) নগদের সঙ্কটে ভুগছে। দ্রুত তা কাটানোর ব্যবস্থা করুক শীর্ষ ব্যাঙ্ক। বন্দোবস্ত হোক তাদের নগদ জোগানের। উর্জিত জমানায় অবস্থান ছিল, তা বলে আর্থিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সমঝোতা নয়। কী করবেন শক্তিকান্ত?
• স্বাধীনতা: শীর্ষ ব্যাঙ্ককে ‘পরামর্শ’ দিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ৭ নম্বর ধারা প্রয়োগে পিছপা হয়নি কেন্দ্র। অভূতপূর্ব ভাবে। ভাঁড়ার ভাগ থেকে দেদার ধার— অনেকের মতে, সবেতেই নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেন্দ্রের কথাবার্তায় স্পষ্ট। এই অবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা রক্ষাই সম্ভবত নতুন গভর্নরের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
অনেকে বলছেন, কেন্দ্র এই ভোটের মুখে ভাঁড়ার ভাগাভাগি, দেদার ঋণ বিলির রাস্তা খোলা ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড চাপ হয়তো তৈরি করবে। কিন্তু তার সামনে নতি স্বীকার না করাই হবে এই প্রাক্তন অর্থ সচিবের মস্ত চ্যালেঞ্জ। তাঁদের মতে, আলোচনার পথে বিরোধ মেটানো খারাপ নয়। বিশেষত যেখানে কেন্দ্র-শীর্ষ ব্যাঙ্কের বিরোধ না থাকাই ভাল। কিন্তু সেই মধ্যপন্থা খুঁজতে গিয়ে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হবে কি না, চিন্তা সেখানেই। যার কিছুটা আঁচ মিলতে পারে ১৪ ডিসেম্বর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড বৈঠকে।
শক্তিকান্তের অর্থনীতির ডিগ্রি না থাকা নিয়ে বিতর্ক আছে। কথা হচ্ছে নোটবন্দির সময়ে সরকারের মুখপাত্র থাকা নিয়েও। কিন্তু অনেকের মতে, এ সব কিছু পিছনে ফেলার সুযোগও তাঁর সামনে। গভর্নর হওয়ার পরেই সুব্বারাও বলেছিলেন, দায়িত্ব নিতে আসার ফ্লাইটেই টুপি বদলেছিলেন তিনি। আমলারটি ছেড়ে গভর্নরের। শক্তিকান্তের সামনেও সেই পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy