চোখ আগামীর দিকে। রঘুরাম রাজন ও উর্জিত পটেল।—ফাইল চিত্র
যাবতীয় জল্পনায় দাঁড়ি।
রঘুরাম রাজনের উত্তরসূরি হিসেবে উর্জিত পটেলের নাম ঘোষণা করে দিল কেন্দ্র। জানাল, আগামী তিন বছরের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেবেন ৫২ বছরের অর্থনীতিবিদ পটেলই। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পরপর দু’দফায় যিনি শীর্ষ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর। অনেকের চোখে রাজন-জমানায় মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার যুদ্ধে অন্যতম যোদ্ধাও।
মাস দু’য়েক আগে এমনই এক শনিবার (১৮ জুন) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষ পদের জন্য দ্বিতীয় দফার দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা আচমকা ঘোষণা করেছিলেন রাজন। তারপর থেকেই এ নিয়ে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েছে জল্পনা। সেখানে পটেল ছাড়াও নাম উঠে এসেছে দুই প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর রাকেশ মোহন ও সুবীর গোকর্ণের। শোনা গিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের কর্ণধার অরুন্ধতী ভট্টাচার্য এবং বিশ্বব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর নামও। যদিও তখনই অনেকে বলেছিলেন, দীর্ঘ দিন ঋণনীতি নির্ধারণে যুক্ত থাকায় এঁদের মধ্যে পটেলের পাল্লাই ভারী। সে দিক থেকে দেখলে, রাজনের বিদায় যতটা চমকে দিয়েছিল, পটেলের মসনদে বসা ততটাই প্রত্যাশিত।
পটেল অষ্টম ডেপুটি গভর্নর, যিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষ পদে উঠে এলেন। একই সঙ্গে কিছুটা ব্যতিক্রমও। কারণ, আগে আর্থিক নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি কর্পোরেট দুনিয়াতেও কাজ করেছেন তিনি। হয়তো সেই কারণেই শিল্পপতি হর্ষ গোয়েন্কার প্রতিক্রিয়া, ‘‘বেসরকারি (রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ), বহুজাতিক (বস্টন কনসাল্টিং), আধা সরকারি (আইডিএফসি) ও সরকারি (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)— সব রকম সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানেই কাজের অভিজ্ঞতা আছে পটেলের।’’ এ দিন কেন্দ্রের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহলও।
কেেন্দ্রর শীর্ষ সূত্রের খবর, পটেলকে গভর্নর করার পিছনে রয়েছে মূলত পাঁচটি ভাবনা:
(১) রাজন চলে যাওয়ার পরেও তাঁর পথ থেকে না-সরা। লগ্নিকারীদের আস্থা জয়ে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াইয়ে একই রকম একবগ্গা থাকা। পটেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ঋণনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন। অনেকের মতে, মাত্রাছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার লড়াইয়ে তিনিই ছিলেন রাজনের ডান হাত। রাজনের উত্তরসূরি হিসেবে তিনি তাই স্বাভাবিক পছন্দ।
(২) ডেপুটি গভর্নর থাকাকালীন পটেলের নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিটি কী কী সুপারিশ করেছে, তা সরকারের টেবিলে রয়েছে। তাই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাদের অচেনা নয়।
(৩) কেন্দ্র এমন কাউকে চাইছিল, বিশ্ব অর্থনীতি ও ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি, দুই বিষয়েই যাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে। সে দিক থেকে পটেল আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারে (আইএমএফ) কাজ করেছেন। আবার দেশের আর্থিক ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে কাজেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
(৪) অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় ও তার পরে (১৯৯৮ থেকে ২০১১) কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন পটেল। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, তখন কাজ করেছেন গুজরাত
স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনেও।
(৫) নিজের কাজের বাইরেও অসহিষ্ণুতা-সহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রায়ই মুখ খুলতেন ‘ঠোঁটকাটা’ রাজন। মোদী সরকার যখন বিশ্বে দ্রুততম বৃদ্ধির হার নিয়ে বড়াই করছে, তখন তাকে ‘অন্ধদের মধ্যে কানা-ই রাজা’ বলতে ছাড়েননি তিনি। পটেলের তেমন কোনও রেকর্ড নেই।
সন্দেহ নেই, জন্মসূত্রে কেনীয় (এখন আর নন) পটেলের সামনে এখন একগুচ্ছ কড়া চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যেমন, কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে আগামী দিনে সুদ নির্ধারণের জন্য ছয় সদস্যের ঋণনীতি কমিটি দ্রুত গড়তে হবে তাঁকে। রাশ টানতে হবে হালে ফের মুখ তুলতে শুরু করা মূল্যবৃদ্ধিতে। বিশেষত যেখানে এই প্রথম আইন করে তার হারের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। রাজনের পথে হেঁটে জেহাদ জারি রাখতে হবে ঋণ খেলাপের সমস্যার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এখনও এ নিয়ে জেরবার।
তা ছাড়া, তিন বছর আগে দেশে ডলার এনে টাকার পতন রুখতে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য ঋণপত্র ছাড়া হয়েছিল। সুদ সমেত তা ফেরানোর সময় এ বছরের শেষেই। লাগবে অন্তত ২,৬০০ কোটি ডলার। তার জন্য তৈরি থাকতে হবে পটেলকে। তৈরি থাকতে হবে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার (ব্রেক্সিট) পরে অস্থির বিশ্ব অর্থনীতিতে টাকার দাম স্থিতিশীল রাখার জন্যও।
তবে সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ সম্ভবত কেন্দ্রের সামনে মাথা না-নুইয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা রক্ষা করা। কারণ, একই সঙ্গে রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় রাখতে হবে তাঁকে। কার্যত দড়ির উপর হাঁটতে হবে সুদ ঠিক করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে দর কষাকষিতে। অনেক ক্ষেত্রে সামলাতে হবে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতো রাজনীতিকের তেতো মন্তব্যও।
সেই হিসেবে এখন পটেলের পরীক্ষা রাজনের ডান হাত থেকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে ওঠা।
ঠিকুজি
• ২৪তম গভর্নর
• বয়স ৫২ বছর
• ৪ সেপ্টেম্বর থেকে
• ৩ বছরের জন্য দায়িত্বে
• অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমফিল। পিএইচডি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
• ২০০৯ সাল থেকে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো
• দু’দফায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর (২০১৩-’১৬ এবং ২০১৬-এখন)। অনেকের মতে, ঋণনীতি ও মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে রঘুরাম রাজনের ডান হাত
• কাজ করেছেন আইএমএফ ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকে
• রয়েছে বস্টন কনসাল্টিং, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ, গুজরাত স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পের মতো বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞতাও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy