আর্থিক বৃদ্ধিতে জ্বালানি জোগাতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উন্নয়ন জরুরি, এই বার্তা দিয়ে কয়েক বছর ধরেই এই খাতে খরচের উপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যগুলিও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছে পরিকাঠামো নির্মাণে। বিশেষ করে পরিকাঠামোয় লগ্নি হলে যেহেতু প্রচুর মানুষ কাজও পান। তবে খাতায়-কলমে দাবির সঙ্গে বাস্তবের ছবিটা যে বেশ খানিকটা আলাদা, তা সামনে এল স্টেট ব্যাঙ্কের একটি গবেষণাপত্রে। সেটি তৈরি করা হয়েছে মূলত চলতি অর্থবর্ষের তিনটি ত্রৈমাসিকের (এপ্রিল-ডিসেম্বর) তথ্যের ভিত্তিতে। দেখা গিয়েছে, ওই সময়ে গত অর্থবর্ষের (২০২৩-২৪) এপ্রিল-ডিসেম্বেরর তুলনায় দেশে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নতির গতি মন্থর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ড— এই তিন রাজ্যে মূলধনী খাতে কিংবা পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ কমেছে সংশ্লিষ্ট অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দের ১০ শতাংশের বেশি হারে।
তালিকায় শীর্ষে অন্ধ্রপ্রদেশ। বাজেট বরাদ্দের ২৭% খরচ করেছে তারা। দ্বিতীয় স্থানে ঝাড়খণ্ড। সেখানে এখনও পর্যন্ত বরাদ্দের মাত্র ১৭% খরচ করা গিয়েছে পরিকাঠামো খাতে। যা গত বার ছিল ৪৮%। আর স্টেট ব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী, আলোচ্য ন’মাসে পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষেত্রে সেই ব্যয় বাজেট বরাদ্দের মাত্র ৩৪%। আগের বছর (২০২৩-২৪) ছিল ৪৫%।
তবে ঠিক উল্টো ছবি পাঁচ রাজ্যে। গত অর্থবর্ষের থেকে পরিকাঠামো নির্মাণে খরচ-খরচা বরাদ্দের তুলনায় সেই সব জায়গায় বেড়েছে এ বার। এই নিরিখে সকলের উপরে পঞ্জাব, খরচ হয়েছে ৫৭%। তার পরে ৪৬% খরচ নিয়ে কর্নাটক। উত্তরাখণ্ডে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৪০%। কেরল ও রাজস্থানে তা বেড়েছে ২ শতাংশ বিন্দু করে।
স্টেট ব্যাঙ্কের এই সমীক্ষায় স্পষ্ট পরিকাঠামো বা মূলধনী খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচও বাজেট বরাদ্দের নিরিখে কম হয়েছে চলতি অর্থবর্ষের ওই ন’মাসে। গত অর্থবর্ষে মোট বরাদ্দের ৬৭% খরচ হয়েছিল। এ বার ৬২%। রাজ্যগুলিকে একত্র করলে তা সার্বিক ভাবে কমে হয়েছে ৪৩%।
যদিও রাজ্য প্রশাসনের এক প্রাক্তন শীর্ষকর্তার মতে, এই তথ্য ঠিক না ভুল সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মানে হয় না। সমগ্র অর্থবর্ষের তথ্য দেখে তার পরেই মন্তব্য করা শ্রেয়। তবে বাংলা-সহ একাধিক রাজ্য যে এই ক্ষেত্রে শ্লথ গতিতে চলছে, তা মেনে নিয়েছেন তিনি। অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এর থেকে অনেকটাই স্পষ্ট যে অর্থনীতির গতি শ্লথ। সরকারের রাজস্ব আদায়ের গতিও ঢিমে। যে কারণে পরিকাঠামো উন্নয়নে হাতেগোনা কয়েকটি রাজ্য ছাড়া বাকি সকলের অগ্রগতি আশাপ্রদ নয়।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, এই ক্ষেত্রে বহু রাজ্য অর্থবর্ষের শেষ তিন-চার মাসে বেশির ভাগ টাকা খরচ করে। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। এ বারও সেই প্রবণতা বজায় থাকে কি না, তা বছর শেষে বোঝা যাবে।
বণিকসভা মার্চেন্টস চেম্বারের অর্থনীতি ও ব্যাঙ্কিং বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান স্মরজিৎ মিত্র এর পিছনে আর্থিক বৃদ্ধির হার আশানুরূপ না হওয়াকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বৃদ্ধি শ্লথ হলে সিমেন্ট, ইস্পাতের মতো শিল্পগুলিও ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য। সেগুলির পণ্যের চাহিদা আটকে যাবে। তাতে আগামী দিনে অর্থনীতির উপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা।’’
তবে স্মরজিৎ-সহ একাংশ পরিকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ার জন্য ভোটকেও দায়ী করছেন। সকলেই একবাক্যে বলছেন, ‘‘বর্তমানে কেন্দ্র হোক বা বিভিন্ন রাজ্য সরকার, সকলেই ‘ভোটমুখী’ প্রকল্পে এত জোর দেয় যে, পরিকাঠামো খাতে খরচ মার খায়। যার ফল ভুগতে হয় দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষকে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)