জানুয়ারিতে ‘বেঙ্গল লিডস-২০১৫’ শিল্প সম্মেলনে লগ্নির সম্ভাবনাময় গন্তব্য হিসেবে রাজ্যকে তুলে ধরতে চান শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। এ জন্য সেখানে শিল্পপতিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিজে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তিনি। অর্থ তালুকে বিনিয়োগ টানতে রতন টাটার ‘ভাঙা’ উদ্ধৃতি ধার করতেও পিছপা হচ্ছে না হিডকো। শিল্পে জোয়ার আনতে সরকারি উদ্যোগে ‘রোড-শো’ হচ্ছে দেশ জুড়ে। অথচ যে-রাজ্য বিনিয়োগের খোঁজে এমন হন্যে, সেখান থেকেই বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে ৬ হাজার কোটি লগ্নির গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প গড়তে আগ্রহী সংস্থাকে! সৌজন্যে রাজ্যের অসহযোগিতা আর ঔদাসিন্য। কিছুটা শাসক দলের গোষ্ঠী কোন্দলও।
পূর্ব মেদিনীপুরের বিচুনিয়ায় বন্দর গড়তে মেকা গোষ্ঠীর শাখা সংস্থা আম্মালাইন্স-কে লেটার অব ইনটেন্ট দিয়েছিল পূর্বতন বাম সরকার। কিন্তু বিস্তর টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত তা নাকচ করে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন।
রাজ্যের দাবি, সেই ২০১০ সালে লেটার অব ইনটেন্ট দেওয়া সত্ত্বেও সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করেনি আম্মালাইন্স। কিন্তু সংস্থার পাল্টা অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি ভেঙেছে রাজ্য সরকারই। এ নিয়ে আসলে পূর্বতন বাম সরকার ও বর্তমান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপড়েনের বলি হচ্ছে তারা। কার্যত মিথ্যা অভিযোগে বন্দর গড়ার প্রকল্প রদ করল রাজ্য। এমনকী সংস্থা সূত্রে খবর, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা না-করলে, আইনি পথ ধরতে বাধ্য হবে তারা।
আম্মালাইন্সের যুক্তি, দ্রুত ওই বন্দর গড়তে সংস্থা বরাবরই আগ্রহী। কিন্তু গোড়া থেকেই তা নিয়ে বিস্তর বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। কখনও নন্দীগ্রামকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ওই এলাকায় কাজ করা যায়নি, তো কখনও বাধা হয়েছে কেন্দ্রের পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি। কখনও জমির মানচিত্র চেয়েই মাসের পর মাস কেটেছে, তো কখনও আবার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের গোষ্ঠী কোন্দল। এখন এই সব কিছুর জেরে সময় নষ্টের দায় রাজ্য তাদের ঘাড়ে চাপানোয় ক্ষুব্ধ সংস্থা।
বন্দর গড়তে ২০০৭ সালে তৎকালীন বাম সরকারের কাছে আগ্রহপত্র জমা দিয়েছিল আম্মালাইন্স। ২০১০ সালে সংস্থার হাতে লেটার অব ইনটেন্ট তুলে দেয় রাজ্যও। সেই অনুযায়ী ২০১০ সালের অগস্টে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছে খসড়া চুক্তিপত্র পাঠায় আম্মালাইন্স। কিন্তু তার শর্ত নিয়ে চাপান উতোরের কারণে চুক্তিসই হয়নি। এর পরে বিধানসভা ভোট এসে পড়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
প্রকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধও। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হলদিয়ায় শিল্প প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিবেশ নিয়ে কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। আটকে যায় ছাড়পত্র। ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে সেই নিষেধাজ্ঞা ওঠে। কিন্তু তাতেও সুরাহা হয়নি।
আম্মালাইন্সের অভিযোগ, জমি, আর্থিক সুবিধা বা বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের তকমা এর কিছুই কোনও দিন রাজ্যের কাছে চায়নি তারা। চাওয়া হয়েছিল শুধু জমির মানচিত্র ও প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু। কিন্তু তার বদলে জুটেছে শুধু প্রশাসনিক ঔদাসিন্য ও অসহযোগিতা। যেমন, বন্দর গড়তে এলাকার রাস্তা উন্নয়নের জন্য কিছু তথ্য দরকার ছিল। অথচ ভূমি ও ভূমি সংস্কার, পূর্ত এবং শিল্প তিন দফতরের কাছে আর্জি জানিয়েও তা মেলেনি। বন্দর নির্মাণের জন্য জায়গা চূড়ান্ত করতে প্রয়োজন জমি জরিপ। সেই জরিপের কাজ শুরুর জন্যও পাওয়া যায়নি শিল্প দফতরের সহযোগিতা। হালে এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে জেলা স্তরে তৃণমূলের অন্দরমহলের কোন্দল।
এই সব সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সময় চেয়ে শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছে একাধিক চিঠি দিয়েছে আম্মালাইন্স। কিন্তু উত্তর আসেনি। ফলে সই হয়নি প্রকল্প তৈরির চুক্তিপত্র। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে গত ৩ নভেম্বর শিল্পমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে ফের চিঠি দেয় সংস্থা। সেখানে তারা স্পষ্ট জানিয়েছিল, বরাবরই এই বন্দর গড়ার কাজে এক পা এগোলে তাদের দু’পা পিছোতে হয়েছে। প্রতি পদে পড়তে হয়েছে অসহযোগিতার মুখে। এর পরেই গত ৫ নভেম্বর সংস্থাকে চিঠি দিয়ে লেটার অব ইনটেন্ট নাকচের কথা জানায় রাজ্য। এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসার জন্য ফোন করলেও, তিনি তা ধরেননি। উত্তর মেলেনি এসএমএসের।
আম্মালাইন্স জানাচ্ছে, গত বছরের শেষেই ওই লেটার অব ইনটেন্ট নাকচ করে দিতে চেয়েছিল রাজ্য। বলেছিল, নতুন করে দরপত্র চাওয়ার কথা। তখন শিল্পমন্ত্রী ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এর পরে ওই দফতরে মন্ত্রী বদলালে সংস্থা মনে করেছিল, এ বার হয়তো সুরাহা হতে পারে। কারণ, ফিকি-র দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো সংস্থার সমস্যা ভাল বুঝবেন অমিতবাবু। কিন্তু বিনিয়োগ হারানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও ফিকি-র প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেলের সেই অভিজ্ঞতা রাজ্য বা আম্মালাইন্সের কাজে লাগল না বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
শিল্পমহলের প্রশ্ন, যেখানে রাজ্যে বড় লগ্নি প্রায় নেই, সেখানে হাতে থাকা বিনিয়োগ-প্রস্তাবকে কেন হেলায় হারাচ্ছে রাজ্য? কেন সংস্থাকে সামান্য তথ্য দিতে এত উদাসীনতা? কেন সমস্যা শোনার সময় দিতে এত অনীহা শিল্পমন্ত্রীর? বিশেষত যেখানে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের দশা বেহাল। এবং এই পরিস্থিতিতে নতুন গভীর সমুদ্র বন্দর কিছুটা হলেও অক্সিজেন জোগাতে পারত রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy