Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Diego Maradona

‘তুমি কি নিজেকে ভগবান মনে করো?’

আর্জেন্টিনায় মারাদোনা যেন স্ববিরোধের প্রতীক। এক দিকে যেমন তিনি অজস্র ভুল-ত্রুটি, বৈপরীত্য নিয়ে চলা অতি সাধারণ মানুষ। অন্য দিকে, সবার মধ্যে যে সেরাটুকু রয়েছে, তিনি তার প্রতীকও!

শ্রদ্ধা: মারাদোনার স্মৃতিতে পোস্টার ও মোমবাতি হাতে পথে ভক্তেরা। বৃহস্পতিবার, যাদবপুরের গাঙ্গুলিবাগানে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শ্রদ্ধা: মারাদোনার স্মৃতিতে পোস্টার ও মোমবাতি হাতে পথে ভক্তেরা। বৃহস্পতিবার, যাদবপুরের গাঙ্গুলিবাগানে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২০ ০২:১৪
Share: Save:

অন্যদের কাছে যা ছিল শুধুই বল, তোমার কাছে তা ছিল ঘুপচি, অন্ধকার জীবন থেকে বেরোনোর একমাত্র ‘টানেল’। তাই অন্য কেউ নিয়ে নিতে পারে, এই আশঙ্কায় তিন বছরের জন্মদিনে পাওয়া বলটা নিয়ে রাতের পর রাত শুতে যাওয়া। সেই ‘টানেল’ যে সচেতন ভাবে তুমি বেছে নিয়েছিলে তা নয়, কোনও জিনিসের সঙ্গে বা কারওর সঙ্গে কারওর যেমন ‘কসমিক’ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তেমন ভাবেই বলের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল তোমার ‘কসমিক’ সংযোগ। যা পাল্টে দিয়েছিল শুধু তোমার জীবনই নয়, একটা গোটা দেশ, একটা গোটা প্রজন্মের জীবন। যে মুহূর্তে বল পায়ে নিয়ে তুমি ওই টানেলে ঢুকেছিলে, সেই মুহূর্ত থেকে তোমার মনে সমুদ্রের ঢেউ! ছোট্ট মনে তখন প্রশ্ন, ‘সমুদ্র, সমুদ্র কোথায়? কোথায় ঢেউ?’ কিন্তু তার উত্তর দেবে কে? এ সব যখন চলছে মনে মনে, তখনই একটা বাঁক এল, বাঁকটা ঘুরলে আর তার পরেই...বালি, ঢেউ, আকাশ...অনন্ত শূন্যতা...

বুয়েনোস আইরেসের ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্যান মার্টিন’-এর ‘স্কুল অব পলিটিক্স অ্যান্ড গভর্নমেন্ট’-এর অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল’-এর অধ্যাপক-গবেষক ফেডেরিকো এম রোসি আনন্দবাজারকে জানাচ্ছেন, আর্জেন্টিনায় মারাদোনা যেন স্ববিরোধের প্রতীক। এক দিকে যেমন তিনি অজস্র ভুল-ত্রুটি, বৈপরীত্য নিয়ে চলা অতি সাধারণ মানুষ। অন্য দিকে, সবার মধ্যে যে সেরাটুকু রয়েছে, তিনি তার প্রতীকও! ফেডেরিকোর কথায়, ‘‘মারাদোনা আসলে সবার ‘হয়ে উঠতে চাওয়া’ এক মানুষ! অবশ্য শুধু তা-ই নয়, এ দেশে যে ক’টা হাতে গোনা জনশ্রুতি রয়েছে, তার একটির নামও মারাদোনা।’’ ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্যান মার্টিন’-এর অন্য এক গবেষকের কথায়, ‘‘আর্জেন্টিনায় যদি কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে যে ‘তুমি কি নিজেকে মারাদোনা মনে করো’, তা হলে ধরে নিতে হবে সে বলতে চাইছে ‘তুমি কি নিজেকে ভগবান মনে করো’?’’

তুমি তো ভগবানই মনে করতে। করতে না? না হলে কী করে ‘ঈশ্বরের হাত’ প্রায় প্রবাদের পর্যায়ে পৌঁছে যায়! আবার সেই ভগবান যখন বল পায়ে নিয়ে দৌড়নো শুরু করে, তখন তার সঙ্গে দৌড়তে শুরু করে একটা গোটা দেশ, সমগ্র বিশ্বের সমস্ত দরিদ্র, ভাল করে না খেতে পাওয়া মানুষের দল। মাঠের মধ্যে বল পায়ে নিয়ে তোমার যে গতি, সেই একই গতি তোমার ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল। যে কারণে কক্ষচ্যুত হওয়াটাও যেন এক রকম অবশ্যম্ভাবীই ছিল!—তাই কখনও ডোপিং, কখনও মাত্রাতিরিক্ত নেশা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনের বূহে ঢুকে পড়েছিলে তুমি। তার পরেও যখন জেনেছ, জীবন বলতে শুধুই বাড়ির মধ্যে সাজিয়ে রাখা কতগুলি নিষ্প্রাণ পালক, মুকুট-সংস্রব নয়, তখনও তোমার সামনে ওই সমুদ্র ধরা পড়েছে। কত দিন যখন জনরাশির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেছ, যখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, অপমানিত, খুঁজে পেতে চাইছ নিজেকে, পাচ্ছ না, তখনও তোমার দিকে ছুড়ে দেওয়া তির, বুলেট, কুৎসিত আক্রমণের বাইরে নিজেকে বার করে এনে দেখেছ ওই অনন্তকে। আশপাশ থেকে তির, বুলেট খসে পড়েছে তখন, কেউ তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি, শুধু একটা বাঁক...আর তার পরেই বালি, ঢেউ, আকাশ, শূন্যে উড়ে যাওয়া গাংচিলের দল...

আর তখন, ঠিক তখনই বুঝতে পারো, হেরে যাওয়া ভূখণ্ডগুলোও আসলে জীবন! আর সেই ভূখণ্ডের সামনে দাঁড়ানো আমরা সকলেই কর্ণ, মেঘনাদ!

আরও পড়ুন: দাবি সত্ত্বেও রাস্তা থেকে উধাও বেসরকারি বাস

সে অবিস্মরণীয় জীবনটুকু এ ভাবেই থাক! যে জীবন অন্যদের অন্ধকার থেকে আলোর উৎসকেন্দ্রে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখাবে। যে স্বপ্ন নিয়ে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রতিদিন অন্ন সংস্থানের সন্ধানে বেরোবে, কখনও জিতবে, কখনও হারবে।

কিন্তু হেরে থেমে যাবে না! একের পর এক সমস্যাকে ‘ড্রিবল’ করতে করতে পৌঁছে যাবে গোলের কাছে। তার পরে পায়ের চকিত ছোঁয়ায়—‘গোওওওওল’!

কবি জয় গোস্বামীর কথায়, "মাঝমাঠ থেকে বল পায়ে নিয়ে মারাদোনার একটা গোলের ভিডিয়ো আমাকে এক বন্ধু দেখিয়েছিল একবার। দশটা আলাদা অ্যাঙ্গেল থেকে। দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল কতটা শিল্পকর্ম একজনের পায়ের ড্রিবলিং-এ, শরীরের ভারসাম্যে থাকতে পারে। সবুজ ঘাসের মধ্যে ওই দৌড়টাই যেন একটা কবিতা হয়ে উঠেছিল।"

আরও পড়ুন: সক্রিয় রোগী কম, বাড়ছে সুস্থতার হার, রাজ্যে করোনা গ্রাফে স্বস্তি​

জয় ঠিকই বলেছেন! কারণ, তোমার জীবন তো আসলে কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের আলোর মতো, না ফুরোনো লড়াইয়ের মতো, আবহমান জীবনের মতো। সেই জয়ের কথা ধার করেই বলতে হয়—

‘রোজ কি অসমযুদ্ধে, রোজ কি খাবার খুঁজতে বেরোই না আমরা অগণন?আমাদের বধ করবে? জন্মায়নি এমন লক্ষ্মণ!’...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Diego Maradona Argentina Icon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE