Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

নিজবলেই গবেষণার বিষয়

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বাঙালিমাত্রেরই গর্বের শেষ নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দু-চারটে বাদ দিলে সত্যজিতের তৈরি বাকি খানপঁচিশেক ছায়াছবি আমাদের চক্ষুস্থ; অন্য দিকে, তাঁর লেখা ফেলুদার কাহিনি ও অন্য সব গল্প তো মুখস্থ হওয়া সত্ত্বেও এখনও নানা মোড়কে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েই চলেছে!

রায় পরিবার: ছয় সন্তান সহ সস্ত্রীক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। (বাঁ দিক থেকে) শান্তিলতা, বিধুমুখী (স্ত্রী), পুণ্যলতা, সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর, (পিছনে) সুবিনয়, সুবিমল ও (একেবারে ডান দিকে) সুখলতা।

রায় পরিবার: ছয় সন্তান সহ সস্ত্রীক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। (বাঁ দিক থেকে) শান্তিলতা, বিধুমুখী (স্ত্রী), পুণ্যলতা, সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর, (পিছনে) সুবিনয়, সুবিমল ও (একেবারে ডান দিকে) সুখলতা।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দ্য রেজ বিফোর সত্যজিৎ / ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড মডার্নিটি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া

লেখক: ছন্দক সেনগুপ্ত

মূল্য: ৯৯৫.০০

প্রকাশক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বাঙালিমাত্রেরই গর্বের শেষ নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দু-চারটে বাদ দিলে সত্যজিতের তৈরি বাকি খানপঁচিশেক ছায়াছবি আমাদের চক্ষুস্থ; অন্য দিকে, তাঁর লেখা ফেলুদার কাহিনি ও অন্য সব গল্প তো মুখস্থ হওয়া সত্ত্বেও এখনও নানা মোড়কে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েই চলেছে! সত্যজিতের আগের আর পরের দুই পুরুষকেও আমরা বিলক্ষণ চিনি— টুনটুনির গল্প-কার ও আবোল তাবোল-এর ছড়াকার হিসেবে যথাক্রমে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও সুকুমার রায়ের নাম শোনেননি এমন বাঙালি ভূভারতে মিলবে না; সন্দীপ রায় পরিচালিত সব সিনেমা না দেখলেও সেগুলোর খবরটুকু আমরা ঠিক রাখি, এমনকী সৌরদীপের ভূমিকাও অজানা নয় ।

গড়পড়তা বাঙালি সঙ্গত কারণেই এই রায় পরিবার সম্বন্ধে জানতে উৎসুক। তাঁদের অনেকের বিষয়েই বেশ কিছু কথা আমরা জানি বইকী— বই পড়েন এমন বাঙালির বইয়ের তাকে উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রচনাবলি (হয়ত বেশি মোটা নয় বলেই) থাকবেই; সত্যজিৎকে নিয়ে অন্যদের লেখা এবং তাঁর নিজের স্মৃতিচারণ (যখন ছোট ছিলাম, আনন্দ) পড়েই উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমারের জীবনের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আমাদের নখদর্পণে।

তবে বাংলার বাইরে এই ছবিটা বেশ আলাদা। ‘রে’ বলতে সেখানে একজনকেই বোঝায়—তিনি সত্যজিৎ। ভারতের বাইরে তিনি হলেন অস্কারজয়ী একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রকার—গদার, কুরোসাওয়ার সঙ্গে তাঁর আসন; আর, ভারতের মধ্যে অন্যান্য প্রদেশে ইংরাজি অনুবাদের কল্যাণে তিনি লেখক ও ফেলুদার স্রষ্টা হিসেবেও সমান বিখ্যাত। কিন্তু অন্য সব রে-জ— বিফোর এবং আফটার সত্যজিৎ— অবাঙালিদের কাছে একেবারেই অজানা, অচেনা।

এহেন পটভূমিকায় ছন্দক সেনগুপ্ত-র বইটির উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। এ বই ইংরাজিতে লেখা ছাড়া ইতিহাসবিদ লেখকের গতি ছিল না; ধরে নিচ্ছি, লেখক চেয়েছেন অবাঙালি ভারতীয় ও বিদেশিদের কাছে সত্যজিৎ ছাড়া রে-পরিবারের অন্যদের পরিচয় দিতে। সেই কাজে তিনি একশো ভাগ সফল। তবে, বাঙালি পাঠকও এই বই পড়ে সত্যজিতের পূর্বজদের ভাল ভাবে চিনতে পারবেন। জন্মের পরে উপেন্দ্রকিশোরের কী নাম ছিল অথবা সুকুমারের ডাকনাম কী সে কথা অনেক বাঙালিই বোধকরি জানেন না; এই বই এরকম অনেক অজানা তথ্যে ভরা। বিস্তর গবেষণালব্ধ এই বই লিখে আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য লেখক এবং প্রকাশককে সাধুবাদ জানাই।

তবে, শুধু উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমারের কথাই এই বইয়ের প্রধান উপজীব্য নয়। প্রাক-সত্যজিৎ রায়-কাহিনির মূল কেন্দ্রে আছেন উনিশ শতকের আরও দুজন অসামান্য বাঙালি ব্যক্তিত্ব— দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর হেমেন্দ্রমোহন বোস; দু’জনের কেউই যদিও রায় নন ! ভারতসভার অন্যতম সংগঠক, ব্রাহ্মসমাজের নেতা দ্বারকানাথ উপেন্দ্রকিশোরের শ্বশুরমশাই আর অন্য দিকে কুন্তলীন-দেলখোশ-তাম্বুলিনের জনক, আর এক ব্রাহ্ম, হেমেন্দ্রমোহন বোস ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ভগ্নীপতি।

মূলতঃ কালানুক্রমিক ভাবে সাজানো বইটিতে ভূমিকা ও শেষকথা বাদ দিলে মোট ছয়টা পরিচ্ছেদ; প্রতিটির কেন্দ্রেই রায় পরিবারের একজন—উপেন্দ্রকিশোরের পূর্বপুরুষ থেকে সুকুমার অবধি। বইটিতে আরও অনেক চরিত্রের সমাগম— স্বয়ং রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহলানবিশ, দ্বারকানাথের দ্বিতীয়া স্ত্রী হিসেবে প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী থেকে সুকুমারের বোন হিসেবে সুখলতা রাও ইত্যাদি ইত্যাদি। এক বিশেষ পরিবারের সদস্যদের জীবনকাহিনির মাধ্যমে দেড়শো বছর আগে পরাধীন ভারতে (পড়ুন, কলকাতায়) কৃষ্টি ও আধুনিকতার (ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড মডার্নিটি) চর্চা ব্যাখ্যা করাই লেখকের কৃতিত্ব।

মানতেই হবে, ছন্দক বাজিমাত করেছেন এক সাহিত্যিক পরিবারের গল্পে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী দুই চরিত্র দ্বারকানাথ আর হেমেন্দ্রমোহনকে পুরোভাগে রেখে। তবে, দ্বারকানাথ আর হেমেন্দ্রমোহনকে ভাল ভাবে চেনালেও, লেখক কিন্তু স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোরের রাজনৈতিক অবস্থানটাই পরিষ্কার করেননি। এই বইয়ের পঞ্চম পরিচ্ছেদে (পৃ. ২৫২-২৫৩) উপেন্দ্রকিশোরের ভূমিকা বেশ স্বদেশি-ঘেঁষা, কিন্তু ‘সন্দেশ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যার প্রথম পাতাতেই ‘গড সেভ দ্য কিং’-এর অনুবাদ এবং ছবি সহ জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিসেবে ‘আমাদের সম্রাট’ পঞ্চম জর্জের চার পাতা জীবনী কেন উপেন্দ্রকিশোর লিখতে গেলেন সে ধোঁয়াশা কাটে না; ছন্দকের অবশ্য মনে হয়েছে এই লেখা নাকি ‘রিমোটলি পলিটিক্যাল’ (পৃ. ৬১)!

‘সন্দেশ’ নিয়ে যথাযথ আলোচনা করলেও ‘কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’য় রায়-দের একটা বড় অবদান কিন্তু ছন্দক আলোর তলায় ধরেননি। ভুললে চলবে না, একশো বছর আগে সুকুমার-সুখলতা শুধু ছোটদের জন্য লেখেননি, ছোটদের বাংলা শেখানোর কথা মাথায় রেখে ছড়া বেঁধেছেন। বাবার থেকে এখানেই তাঁরা এগিয়ে। তৎকালীন ‘সহজ পাঠ’ শিশুসাহিত্য হিসেবে হয়ত এগিয়ে, কিন্তু শিশুদের বাংলা শেখানোর জন্য ‘নাম তার মোতিবিল’-র চেয়ে ‘মাসি গো মাসি’ অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত। উপেন্দ্রকিশোরের জীবদ্দশাতেই কিন্তু ‘সন্দেশ’-এর পাতায় ‘আবোল তাবোল’ নামে একাধিক ছড়া সুকুমার লিখেছেন ও তার সঙ্গে ছবি এঁকেছেন, তাতে UR-য়ের নকলে SR সই করেছেন। বাংলা-শেখা বিষয়টাই এই বইতে লেখক এড়িয়ে গেলেন! সুখলতার জন্যও মাত্র আড়াই পাতা বরাদ্দ দেখে বেশ দুঃখ পেলাম।

লেখার আগে ছন্দক বিস্তর গবেষণা করেছেন তার প্রমাণ মিলবে অজস্র পাদটীকায়; কিন্তু তা বলে বইয়ের শতকরা চল্লিশ ভাগ (৩৯৭ পাতার মধ্যে ১৫৮ পাতা)! মূল অংশে এদের ঠাঁই নেই কেন? বইতে বাংলা শব্দের ব্যবহার অনেক, যদিও সেগুলোর ব্যাখ্যা আছে, দু-একটা বাদে; যেমন, ‘আদালত’-এর ‘সেরেস্তাদার’ (পৃ. ৫০), ‘সাধু’ ভাষার ইংরাজি হয়েছে ‘সিরিয়াস’ (পৃ. ৩২৪)।

আরও একটা আক্ষেপ; বইয়ের গোড়াতেই লেখক জানিয়েছেন সত্যজিতের জীবনী নিয়ে গবেষণা করতে বসেই পূর্বজদের অবদান তাঁর চোখে পড়ে। উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার কিন্তু পৌত্র ও পুত্রের দ্যুতিতে উজ্জ্বল না হয়েও, নিজবলে গবেষণার বিষয় হওয়ার দাবি করতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Satyajit Ray Sukumar Ray
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE