Advertisement
E-Paper

জীবনের গভীরে জড়ানো শিল্পিত সৌন্দর্য

সিমা গ্যালারিতে চলছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ প্রদর্শনী। দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষমানুষের অঙ্গবস্ত্র বা পোশাকের মধ্যে থাকে তাঁর যে শিল্পিত সত্তার পরিচয়, তা কখনওই উপেক্ষার নয়। তাঁর রুচি বা জীবনবোধের আভাস থাকে এর মধ্যে। তাকে আমরা কারুকলা বলতে পারি, কিন্তু চারুকলা থেকে তার দূরত্ব খুব বেশি নয়।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
আর্ট ইন লাইফ প্রদর্শনীর একটি ছবি

আর্ট ইন লাইফ প্রদর্শনীর একটি ছবি

মানুষের অঙ্গবস্ত্র বা পোশাকের মধ্যে থাকে তাঁর যে শিল্পিত সত্তার পরিচয়, তা কখনওই উপেক্ষার নয়। তাঁর রুচি বা জীবনবোধের আভাস থাকে এর মধ্যে। তাকে আমরা কারুকলা বলতে পারি, কিন্তু চারুকলা থেকে তার দূরত্ব খুব বেশি নয়।

আজকে মানুষের পরিধানের যে বস্ত্র, তার বিবর্তনের ইতিহাস সভ্যতার ইতিহাসেরই সমবয়সি। একেবারে আদিতে গাছের পাতাই ছিল মানুষের পোশাক। তার পর এল গাছের বাকল থেকে তৈরি বস্ত্র। সাঁচি স্তূপের স্তম্ভে যে সব মূর্তি আছে তারা প্রায় সকলেই গাছের বাকল পরিহিত। এই বাকল থেকে তৈরি বস্ত্রকে বলা হত ‘ক্ষৌম’। ভাল ‘ক্ষৌম’-কে ‘দুকুল’-ও বলা হত। এই ‘দুকুল-এর পরে এল কার্পাসের কাপড়। তারই বিবর্তনে এল মসলিন। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন, ‘খ্রিস্ট জন্মানোর দুশো বছর আগে গ্রিসের বাজারে চালু ছিল ভারতের মসলিন’। তার পর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বস্ত্রের বিবর্তন ঘটেছে। যেমন বাংলা বা কেরলে যেখানে প্রকৃতি শ্যামলিম ও বর্ণময়, সেখানে মানুষ শুভ্রতায় নিজেকে সাজাতে ভালবাসে। রাজস্থান ও গুজরাতে বর্ণবিরল মরুভূমির প্রেক্ষাপটে নিজেকে উজ্জীবিত করতে মানুষের পোশাকে আসে বর্ণের ঝংকার। দাক্ষিণাত্যের বস্ত্রে থাকে ভূমিজ রঙের প্রাধান্য। দক্ষিণে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কর্নাটকেও মানুষ পছন্দ করে বর্ণের বৈচিত্র।

সিমা গ্যালারিতে প্রতি বছরের মতো শারদোৎসবের প্রাক্কালে চলছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ নামে প্রদর্শনী। জীবনের ভিতর কেমন করে জড়িয়ে থাকে শিল্পিত সৌন্দর্য তার নানা দৃষ্টান্ত নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। বস্ত্র ও পোশাকের সমারোহ এর বিশেষ একটি দিক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বস্ত্রবয়নশিল্পীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় তাঁদের তৈরি বস্ত্রসম্ভার। অলঙ্করণের ভিন্ন পদ্ধতি কেমন করে চর্চিত হয় বিভিন্ন অঞ্চলে, তারই নানা দৃষ্টান্তে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনী। এ বছরের সংগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে গুজরাত। সেখানকার ‘আশাবলি’ ও ‘পাটোলা’ শাড়ি বর্ণে ও অলঙ্করণে অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যময়। আমদাবাদের এই ‘আশাবলি’ পঞ্চদশ শতক থেকে চর্চিত হয়ে আসছে। সময়ের ছন্দে বিবর্তনও ঘটে যাচ্ছে। সুতোর তৈরি ‘পৈতানি’ শাড়ির সূক্ষ্ম বুননে আলোর প্রতিফলন এমন স্বতন্ত্র তাতে রেশমি সুতোর উজ্জ্বলতা আসে। এদের অলঙ্করণ চিত্রপ্রতিম। এই চিত্রীয় বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বলতর দৃষ্টান্ত দেখা গেল ‘কিচওয়াই’ নামে নাথদ্বারা-র এক বয়ন কারুকার্যে। বস্ত্রের পরিসর জুড়ে হালকা সবুজ ও গেরুয়া রঙে সুস্মিতভাবে ছড়ানো গাভীর প্রতিমাকল্প। পৌনঃপুনিকতা সেখানে এনেছে কম্পোজিশনের যে ভারসাম্য তার চিত্রলতা অবিস্মরণীয়। এভাবে অন্ধ্রপ্রদেশের ‘ইক্কত’, ‘কালাহস্তি’, তামিলনাড়ুর ‘চেট্টিনাদ’, বাংলার নানা ঘরানার শাড়িতে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনী।

বস্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শৌখিনতা। যা থেকে জন্ম নেয় ‘ফ্যাশন’। ফ্যাশন নিয়ন্ত্রিত হয় ধনতান্ত্রিকতা দ্বারা। তখন তা হয়ে ওঠে মানুষের আত্মবিশ্বাস সঞ্চারের প্রধান অবলম্বন। অর্থাৎ ফ্যাশনহীন মানুষ নিরাপত্তাহীন। তাই ফ্যাশনকে করে তুলতে হয় সতত পরিবর্তনশীল। তা হয়ে ওঠে এক নিয়ত বিপ্লব। এই বিপ্লব সঞ্জীবিত রাখতে ক্রমাগত এক অভাববোধ জাগিয়ে রাখা হয়। তা থেকেই আসে আত্মবিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে বিমুক্ত হতে মানুষ নিজেকে নব নব সাজে সজ্জিত করে। ফলে বাজার বাড়ে। মুনাফা বাড়ে। এই প্রদর্শনীতে উদ্ভাসিত হয়েছে ফ্যাশনের নানা দিগন্ত। আমাদের এই সময়কে আমরা চিনে নিতে পারি।

প্রাক্-আধুনিক যুগে মানুষের ভিতর এই বিচ্ছিন্নতা ছিল না। তারই পরিচয় ধরা আছে প্রদর্শনীর আদিবাসী ভাস্কর্যগুলোতে। আজও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লৌকিক ও আদিবাসী শিল্পীদের নির্মিত মুখোশ বা ভাস্কর্যের ভিতর প্রবাহিত হয়ে আসছে সনাতন এক কৌম প্রজ্ঞা, যার প্রতিফলন আজকের ললিত শিল্পেও। মানুষের অন্তর্নিহিত সংকট ও সৌন্দর্যকে একই সঙ্গে উদ্ঘাটিত করা হয় রূপের বিশেষ বিন্যাসে। যখন মানুষের শীর্ণ অবয়বকে দীর্ঘায়ত করে স্বাভাবিকতা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হয় রূপারোপকে, তখন সৌন্দর্যের যে বিশেষ এক নিরিখ নির্ধারিত হয় তাতে আঞ্চলিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার এক সমন্বয় ঘটে। পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী শিল্পও এই রূপরীতির থেকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছে। কাজেই এই প্রদর্শনী বিপণনের সম্ভার ছাড়িয়ে আমাদের সাহায্য করে সভ্যতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যচেতনাকে বুঝতে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy