Advertisement
E-Paper

একটা শুরু তো করা যেতেই পারে

বা র্গম্যান’ না ‘বেয়ারিমান’? ‘রেনোয়া’ না ‘রনোয়ার’? ‘গ্রামচি’ না ‘গ্রামশি’? এ এক ধরনের বিপন্নতা। এমনিতেই বাংলা বানানের হাজার সমস্যা।

চিন্ময় গুহ

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
সংসদ বিদেশি নামের উচ্চারণ। সুভাষ ভট্টাচার্য। সাহিত্য সংসদ, ২০০.০০

সংসদ বিদেশি নামের উচ্চারণ। সুভাষ ভট্টাচার্য। সাহিত্য সংসদ, ২০০.০০

বা র্গম্যান’ না ‘বেয়ারিমান’? ‘রেনোয়া’ না ‘রনোয়ার’? ‘গ্রামচি’ না ‘গ্রামশি’? এ এক ধরনের বিপন্নতা। এমনিতেই বাংলা বানানের হাজার সমস্যা। তার ওপর প্রতি দিন খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকা এবং ছোট পর্দায় নানা আন্তর্জাতিক স্থাননাম ও ব্যক্তিনামের ভুল প্রতিবর্ণীকরণ দেখে বিভ্রান্তি বাড়ে। গত আড়াই দশকে গোলকায়নের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ছোট পর্দায় ভুল প্রস্বরে হিস্টিরিয়ার ধরনে সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে আমরা যেমন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, তেমনই হয়েছি বিদেশি ব্যক্তিনাম ও স্থাননামের প্রয়োগে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে। এর আসল কারণ নিজের ও অন্যের ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা।

বিদেশি নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রটি কোনও অর্থেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে সেই বাঙালির কাছে যে দু’শতাব্দী আগে খুলে দিয়েছিল বিশ্বজ্ঞানের জানলা, দীর্ঘকাল ধরে যে ভাষাভাষীর মধ্যে বহুভাষিকের সংখ্যা ছিল ঈর্ষণীয়। অনেকের মনে পড়বে, জীবনের এক চরম সংকটের মুহূর্তে, যখন ঋণের দায়ে জেলে যাওয়ার উপক্রম, ফ্রান্সের ভের্সাই থেকে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিতে মধুসূদন পাঁচটি ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষার কথা বলেছেন। তার আগে মাদ্রাজে হিব্রু, গ্রিক, লাতিন, তামিল ও তেলেগু শিখতে শিখতে গৌরদাসকে লিখেছিলেন, ‘Am I not preparing for the great object of embellishing the tongue of my fathers?’ রামমোহন, ডিরোজিও, মধুসূদন, তরু ও অরু দত্ত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ (যিনি ফ্রান্সকে ‘ফ্রাঁস’ আর প্যারিসকে ‘পারি’ লিখতে সাহস করেছেন), প্রমথ চৌধুরী, সুনীতিকুমার, হরিনাথ দে, সৈয়দ মুজতবা আলীর বঙ্গে এখন ত্রৈভাষিক তো দূরের কথা, প্রকৃত দ্বিভাষিকের সংখ্যাও দ্রুত কমে আসছে। কাজেই বিশ্বভাষার সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য দেখে অবাক হওয়ার কারণ নেই। গোলকায়নের যুগে এই স্ববিরোধ আমাদের ভবিতব্য ছিল।

নিন্দুকেরা বলেন, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, চলচ্চিত্রকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান ও খেলোয়াড়দের নামের বিকৃতি শুনে নামের মালিকেরা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। সম্প্রতি ‘ইউরো কাপ’ ফুটবলের সময় সংবাদপত্রের পাতায় বেশির ভাগ নামের প্রতিবর্ণীকরণ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এতে শুধু পাঠকদের প্রতি অবিচার করা হয়নি, খেলোয়াড়দের প্রতিও হয়েছে। স্বয়ং জ্যোতিভূষণ চাকী যদি ভাষা-বিশেষজ্ঞের কাছে মূল উচ্চারণটি জেনে নিতে পারেন, তা হলে অন্যেরা নয় কেন?

কারও পারিবারিক নাম বা ভৌগোলিক নাম পরিবর্তনের অধিকার কি আমাদের আছে? এর উত্তর হল, না। তবু আমরা অনেকেই জেনে বা না জেনে এই দুষ্কর্ম করে থাকি। আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম না। যিনি দায়িত্বহীনতার কারণে অন্যের নাম লেখার সময় যথেচ্ছচার করেন, তিনিই কিন্তু তাঁর নিজের নামের বানানে পান থেকে চুন খসলে খড়্গহস্ত হবেন। এই ত্রুটি অবশ্য শুধু একালেই সীমাবদ্ধ নয়। রবীন্দ্রোত্তর যুগের এক অতি সম্মানিত কবির কথা মনে পড়ছে, যাঁর ফরাসি উচ্চারণ এক বিশিষ্ট কবি-ভাষাবিদ শুদ্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি পরবর্তী সংস্করণে তা বদলাননি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অস্মিতা।

মুস্কিল হচ্ছে, সবচেয়ে সমস্যা সৃষ্টি করেন তাঁরাই যাঁরা ভাষাটি সামান্যই জানেন, হয়তো দু’চার মাস শিখেছেন, মূল ভাষাভাষীর সঙ্গে কথা বলে যাচাই করার প্রশ্নই ওঠে না। ষাটের দশকে স্বয়ং সৈয়দ মুজতবা আলী এবং অরুণ মিত্র প্রতিবর্ণীকরণের বিশৃঙ্খলা ঘোচাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে এই অর্ধশিক্ষিতদের দাপটে রণে ভঙ্গ দেন।

আমাদের অভিধানকার ও ভাষাবিদদের মধ্যে বিদেশি নামের উচ্চারণের নৈরাজ্যের সমাধানে যিনি সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেছেন তিনি সুভাষ ভট্টাচার্য। অন্যান্য নানা জরুরি কাজের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তিনি একটি শুদ্ধ ও মান্য উচ্চারণ পদ্ধতি প্রবর্তনের নিরলস প্রয়াস করে চলেছেন।

তিরিশ বছর আগে এই গুরুত্বপূর্ণ অভিধানটি যখন প্রথম বার প্রকাশিত হয়, সেখানে লাতিন, ফরাসি, ইতালীয়, স্পেনীয় ও পর্তুগিজ ভাষার স্থাননাম ও ব্যক্তিনামের উচ্চারণ দেখানো হয়েছিল। সঙ্গে সেই ভাষাগুলির উচ্চারণ পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত আলোচনা। সুভাষবাবু লিখেছেন, দ্বিতীয় খণ্ডে ‘জার্মান, চেক, ডেনীয়, সুইডিশ, ডাচ, নরওয়েজীয়, পোলিশ প্রভৃতি ভাষার নাম যোগ করার পরিকল্পনা ছিল।’ এ বারে সেগুলি ছাড়াও যুক্ত হয়েছে রুশ, গ্রিক, হাঙ্গেরীয় এবং চারটি এশীয় ভাষা: আরবি, ফারসি, চিনা ও জাপানি। আজ ক্রমবিকাশমান বিদ্যাচর্চার প্রয়োজন মেটাতে এই সম্পূর্ণ নতুন অখণ্ড সংস্করণটি অবশ্যই শিক্ষিত লেখকদের কাছে একটি প্রাত্যহিক ব্যবহার্য গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হবে। সুভাষবাবুর ভাষায়, ‘পৃথিবীর সব ভাষার নামের উচ্চারণ যে এভাবে জানা হয়ে যাবে তা নয়। তবে একটা শুরু তো করা যেতেই পারে।‘

অভিধানের শুরুতে ভাষাগুলির বিচিত্র উচ্চারণ পদ্ধতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘকাল বিদেশি ভাষার শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, এই দুরূহ কাজে সুভাষ ভট্টাচার্য অত্যাশ্চর্য রকম সফল। এই অংশটি একবার পড়ে নিলে পাঠক নিজেই সঠিক ভাবে অধিকাংশ নাম যথাসাধ্য শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারবেন। ‘যথাসাধ্য’ বললাম এই জন্য যে সব কিছু আমাদের জিভ ও টাকরার আয়ত্তাধীন নয়। তা ছাড়া মানুষে মানুষে সূক্ষ্ম উচ্চারণভেদ থেকেই যায়।

সুভাষ ভট্টাচার্য বর্ণানুক্রমিক ভাবে রোমান হরফে এই অভিধান প্রস্তুত করেছেন। পাশে বন্ধনীর মধ্যে ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যুসাল, সংক্ষিপ্ত ও যথাযোগ্য পরিচয় এবং শেষে উচ্চারণ, এমনকী বিকল্প উচ্চারণ। অনেক সময় কোনও বিশিষ্ট লেখকের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম জানাতেও ভোলেননি। অনেক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠক জানতে পারবেন ‘ব্রাঁকুসি’ বলে ফরাসি উচ্চারণে পরিচিত রোমানীয় শিল্পীর প্রকৃত নাম ‘কনস্তানতিন ব্রাংকুজি’। কিংবা কলম্বাস সাহেবের ইতালীয় নাম আসলে ‘ক্রিস্তোফোরো কোলোম্বো’! ‘জ’, ‘ভ’ ও ‘ফ’-র নীচে ফুটকি দিয়ে নানা ধরনের উচ্চারণের বিস্তার স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ফরাসি ভাষার ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি নামের এমন নিখুঁত সমাহার আমি একমাত্র অরুণ মিত্র ও নলিনীকান্ত গুপ্তের রচনা ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। মান্য প্যারিসীয় উচ্চারণের জন্য পাঠক সানন্দে এই বইটির সাহায্য নিতে পারেন। যৎসামান্য দু’একটি সমস্যা পরবর্তী সংস্করণে পরিমার্জনা করা যাবে। যাঁরা সুনীতিকুমার, প্রমথ চৌধুরী, মুজতবা আলী ও অরুণ মিত্রকে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা পুনর্বার এ বইতে জানতে পারবেন ‘জঁ’ নয়, ফরাসিতে চার রকম আনুনাসিক উচ্চারণ অনুযায়ী ‘জাঁ’; ‘অঁরি’ নয়, ‘আঁরি’; ‘ফ্রঁস’ নয়, ‘ফ্রাঁস’। ‘আঁ’ (en, an) এবং ‘অঁ’ (on)-র পার্থক্য করা বিদেশি ছাত্রের প্রাথমিক কাজের মধ্যে পড়ে। অবশ্য দাঁত বা মাড়ির সমস্যা থাকলে আলাদা কথা! অঞ্চল অনুযায়ী সব দেশেই কিছু উচ্চারণভেদ থাকে, যেমন দক্ষিণ ফ্রান্স ও প্যারিসে, ইয়র্কশায়ার ও লন্ডনে। কিন্তু ‘standardized’ উচ্চারণই বিচার্য, যেমন বিবিসি ইংরেজি বা প্যারিসীয় অঞ্চলের ‘লিল দ্য ফ্রাঁস’ ফরাসি। কারও সন্দেহ হলে যে কোনও প্রামাণিক অভিধানে বা আন্তর্জালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট’ দেখে নিতে পারেন, যাতে সব সংশয়ের অবসান হবে।

পাঠককে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই বিরাট পৃথিবীতে জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে ব্যক্তিনামের গুরুত্ব বাড়ছে, কমছে; সাহিত্য, দর্শন বা বিজ্ঞানই হোক অথবা চিত্রকলা, অনবরত নতুন নাম আসছে আর যাচ্ছে। কাজেই এই নামাবলি একটি জায়মান বিন্যাস।

এই বহু-প্রতীক্ষিত অভিধানটি নিঃসন্দেহে একটি অতি প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বুক। বহু জনের কাজ সুভাষ ভট্টাচার্য একা করেছেন। এবার বিদ্বজ্জনেরা একমত হলে দু’একটি ঢেঁকি গিলে বিদেশি ভাষার নামের নৈরাজ্য মিটতে পারে। এও ঠিক করতে হবে, আমরা শুদ্ধ অথচ অপ্রচলিত বানান প্রবর্তন করব, নাকি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রচলিত বানানে হস্তক্ষেপ করব না। এগুলি জরুরি প্রশ্ন। সুভাষ ভট্টাচার্য ও সাহিত্য সংসদ একটি নতুন দিশা দিলেন।

book pronunciation of foreign names
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy