Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয়১

শিরশিরে অনুভূতির টানে

ছেলেবেলায় গুরুজনদের অনেককেই দেখতাম কোনও এক সাধুজির লেখা বই পড়তে। বইয়ের বিষয় নিয়ে সেই বয়সে কোনও আকর্ষণ ছিল না। আমাকে অবাক করেছিল বইটির কিছু ছবি।

অরিন্দম দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

উপছায়া/ সেকাল ও একালের লেখকের বিখ্যাত ভূতের গল্প সংকলন

সম্পাদক: সুকুমার সেন ও সুভদ্রকুমার সেন

মূল্য: ৩৫০.০০

প্রকাশক: সিগনেট

ছেলেবেলায় গুরুজনদের অনেককেই দেখতাম কোনও এক সাধুজির লেখা বই পড়তে। বইয়ের বিষয় নিয়ে সেই বয়সে কোনও আকর্ষণ ছিল না। আমাকে অবাক করেছিল বইটির কিছু ছবি। কোনও এক আশ্চর্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল আত্মাদের আনাগোনার মুহূর্ত। আমিও কল্পনা করতাম যে সব নিকট আত্মীয়দের ছবি ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকে, তাঁরা যদি উপছায়ার মতো সামনে হাজির হন তবে কেমন হয়! কল্পনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, রাতদুপুরে তাঁরা যদি আমার সামনে হাজির হন তা হলে ব্যাপারটা খুব ভাল লাগবে না। এই অস্বস্তি আর গা শিরশিরে ভাবটাই হল ভাল ভূতের গল্পের সাফল্য। ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস থাকুক চাই না থাকুক এই শিরশিরানির অনুভূতির টানেই পাঠক গল্পের সঙ্গে সেঁটে যায়। ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক তো আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে। প্রায় সব দেশেই ভূত থাকে, কেবল স্থান ভেদে তাদের নাম আর আকার-আকৃতি পাল্টে পাল্টে যায়। গুরুবাদী বলে তো ভারতীয়দের বদনাম আছেই, সেই সঙ্গে ঝাড়ফুঁক-তুকতাক-ভূতপেত্নি সবের সঙ্গেই সহবাস, কিন্তু যাঁরা নাকি আমাদের তথাকথিত যুক্তিবাদ আর আধুনিক বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন বলে মনে করা হয় সেই পশ্চিমের মানুষরাই বা ভূতচর্চায় কম যান কী সে! তাঁরা যে কতটা ভূত বিশ্বাসী তা জানার জন্য বিলেত-আমেরিকা যাওয়ার দরকার পড়ে না। একদা ভারতে থিয়োজফিক্যাল সোসাইটির রমরমাই তার প্রমাণ। তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিত অকাল্ট চর্চায়।

বাংলার জেলায় জেলায় ভূত চর্চার রেওয়াজ থাকলেও তাকে প্রথম অ্যাকাডেমিক গণ্ডিতে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন সুকুমার সেন। অভিজ্ঞতা কী হয়েছিল সেটা তাঁর নিজের কথাতেই শোনা যাক, ‘‘বিশ্বভারতী পত্রিকায় ‘আমাদের সাহিত্যে ভূতের গল্প’ নামে প্রবন্ধ আকারে বার হয়েছিল। প্রবন্ধটির শেষে আমি আশা প্রকাশ করেছিলুম যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা হবে। বলা বাহুল্য তা কিছুই হয়নি।’’ এর পরেও কিন্তু তিনি বিষয়টি নিয়ে চর্চা থামিয়ে দেননি। ফলে আমরা যারা ভূতের গল্প শুনতে আগ্রহী পেয়েছিলাম তাঁর এবং সুভদ্রকুমার সেনের যৌথ সম্পাদনায় উপছায়া বইটি। বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রথমে ১৩৭১-এ, তার পর ১৪০৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয় বার বইটি ছাপে। এর পর আরও নানা ভৌতিক কাহিনির সংকলন প্রকাশিত হয়। মজার কথা, সেগুলির মধ্যেও ঠাঁই পেয়েছিল উপছায়া-র নির্বাচিত ৩৩টি গল্পের বেশ কয়েকটি। যা ফিরে প্রমাণ করে সুকুমার সেনদেরই সাফল্য। উপছায়া-র সম্পাদকরা কেন ঠিক ওই ৩৩টি গল্প বেছে নেন তা নিয়ে প্রশ্ন অবান্তর। বরং পরের সম্পাদকদের জিজ্ঞেস করা যায়, কেন তাঁরা পরিশ্রম করলেন না অন্যান্য গল্প সংগ্রহ করার। ভূতের গল্পের যাঁরা সমঝদার পাঠক তাঁদের সংগ্রহে উপছায়া-র গরহাজিরি এত দিন বেমানান ছিল। সিগনেট প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ায় সেই শূন্যস্থান ভরাট হবে বলেই আশা করা যায়।

আদালতের ঘরে বাইরে / এক আইনজীবীর ফিরে দেখা

লেখক: নরনারায়ণ গুপ্ত

মূল্য: ৩০০.০০

প্রকাশক: আনন্দ

অমন বড়লোক বাড়ির ছেলে কমিউনিস্ট পার্টিতে এসে কী করবে? প্রশ্নটা করেছিলেন মুজফ্‌ফর আহমেদ। প্রশ্নটা স্বাভাবিক। ডাক্তার দ্বারিকনাথ গুপ্তের নাতি নরনারায়ণ জন্মেই ছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। কিন্তু বিধি যাঁর বাম, তাঁকে ঠেকাবে কে? স্কুলজীবনে ডেকার্স লেনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে আনাগোনা থেকে যে যাত্রা শুরু হল তা ক্রমেই নরনারায়ণবাবুকে নিয়ে যাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একেবারে অন্দরমহলে। যে মহলে তখন তারকাদের সারি। সেই অন্দরের কথাই উঠে এসেছে তাঁর লেখা আলোচ্য বইটিতে। ২০১১-এ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভরাডুবির পরে এই বইয়ের ভাবনা। গদ্যের চলনে গল্প বলার ভঙ্গিটি সহজেই পাঠকের মন কাড়বে। পারিবারিক ইতিহাস, পড়াশোনার জীবন ছুঁয়ে তা চলে যায় তাঁর আদালত-জীবন ও রাজনীতি চর্চায়। দু’টি অবশ্য একে অপরের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল নরনারায়ণ গুপ্ত তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ঝুলিটি উপুড় করে দিয়েছেন। কয়েকটি জায়গায় ইতিহাস চর্চা ক্লান্তিকর হলেও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই দিশাহীন সময়ে বইটি জরুরি পাঠ্য।

নটে গাছ ও অন্যান্য লেখা

লেখক: ব্রাত্য বসু

মূল্য: ৩০০.০০

প্রকাশক: কারিগর

তত দিনে মাধ্যমিক পাশ করে গিয়েছেন, আশির দশকের মাঝামাঝি, বাড়িতে টিভি ঢুকে পড়েছে, তবুও নিয়মিত মাঠে যাওয়া শুরু ব্রাত্য বসুর। কত শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, কখনও ম্যাটাডর কখনও অটো চেপে, লরিতে কিংবা শাট্‌ল ট্যাক্সিতে, কখনও-বা ঠাসা ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে, এমনকী হেঁটেও। নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো ফুটবল নিয়ে তাঁর গদ্য ‘শ্যাওলাধরা বাড়ি, ভুটভুটির শব্দ আর একটি গোলাকার দৃশ্যের জন্ম’ নিছক আর আত্মস্মৃতি থাকে না যখন তিনি লেখেন ‘ওই গোলাকার সাদাকালো ডোরাকাটা খণ্ডটিতে শট্‌ মারা যাবে আর সেই শট্‌ মাটি থেকে শূন্যে উঠে রাতের তারা হয়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের জীবনে। এ সবই ভাবি। এ সবই কেন জানি না আমাকে আরও নিরাসক্ত আরও শান্ত হতে সাহায্য করে।’ এ রকমই ক্রিকেট নিয়ে ‘ছোটেদাকে লেখা চিঠি, ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ আর ন্যাড়াপোড়া সেই বাইশ গজ’-এর সঙ্গে ‘এক ছোকরার জীবনচর্চা ও আমার জীবনে বাংলা কবিতা’ ও সর্বোপরি থিয়েটার নিয়ে ‘নট-এ গাছ’ সব মিলিয়ে ব্রাত্যর এই গদ্যগ্রন্থটি আসলে গত শতাব্দীর শেষান্তে নাগরিক বঙ্গজীবনের সমাজজিজ্ঞাসার এমন এক ভাষ্য, যা মনন আর লাবণ্যের মেলবন্ধন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE