Advertisement
E-Paper

সংস্কৃত আসলে গৌণ, উদ্দেশ্য অন্য

সংস্কৃতের জন্য যুদ্ধ। নামটি শুনলে সম্ভ্রম জাগে। বইটির পৃষ্ঠ-প্রচ্ছদে মুদ্রিত বিশিষ্ট জনের মতামতে আছে, ভারতীয় ও পশ্চিমী ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে যাঁরা ‘যুক্তিবাদী’, তাঁদের কাছে এই বই দীর্ঘ কাল আদৃত হবে।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
দ্য ব্যাটল ফর স্যান্‌সক্রিট, রাজীব মালহোত্র। হার্পার কলিন্স, ৬৯৯.০০

দ্য ব্যাটল ফর স্যান্‌সক্রিট, রাজীব মালহোত্র। হার্পার কলিন্স, ৬৯৯.০০

সংস্কৃতের জন্য যুদ্ধ। নামটি শুনলে সম্ভ্রম জাগে। বইটির পৃষ্ঠ-প্রচ্ছদে মুদ্রিত বিশিষ্ট জনের মতামতে আছে, ভারতীয় ও পশ্চিমী ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে যাঁরা ‘যুক্তিবাদী’, তাঁদের কাছে এই বই দীর্ঘ কাল আদৃত হবে। বিজ্ঞাপনের ভাষা বাড়িয়েই বলে, কিন্তু চারশো পাতার বইটি পড়তে গিয়ে দেখা গেল, ‘যুক্তি’ বিষয়টি লেখকের খুব পছন্দের নয়। কিংবা, বলা যায়, তিনি নিজের ‘যুক্তি’র বাইরে অন্য কিছুতে কান দিতেই রাজি নন।

বইটির উপ-শিরোনাম কয়েকটি প্রশ্নে। সংস্কৃত রাজনীতির ভাষা না পবিত্র দেবভাষা? ভাষাটি মৃত না জীবন্ত? অত্যাচার করে না মানুষকে মুক্তি দেয়? প্রশ্নগুলি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা এগিয়ে বোঝা গেল, পুরো বইটি শেল্ডন পোলকের বিরুদ্ধে। শেল্ডন সংস্কৃতকে প্রাগ-আধুনিক ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন, তাঁকে ‘পূর্বপক্ষ’ খাড়া করে রাজীব মালহোত্র ‘উত্তরপক্ষ’ হতে চান। সে ভাল কথা। পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষের দার্শনিক বিতর্ক এই তর্কশীল ভারতের উত্তরাধিকার।

কিন্তু বিতর্ক হল কোথায়? ৩৪৫ পৃষ্ঠায় চলে এল হাল আমলের ‘মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরি’। শেল্ডন লিখেছিলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা বলে, রাষ্ট্রের মৃত হাত এই প্রকল্পে এগিয়ে আসবে না। কোনও আলোকপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থাই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে।’ এই সব নিরামিষ কথাতেও রাজীবের রাগ। ‘সরকারি ইনস্টিটিউশন’ কথাটা ব্যঙ্গচ্ছলে বলা হল কেন? ‘আলোকপ্রাপ্ত’ সংস্থা তো ইউরোপীয় র‌্যাশনাল চিন্তা, ভারতীয় মোক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায়?

ঘটনা, মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরির সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্ক নেই। ওই গ্রন্থমালা হিন্দি, ফার্সি, তামিল, তেলুগু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভারতীয় ভাষার প্রাচীন সাহিত্যকে মূল লিপির মুখোমুখি ইংরেজি অনুবাদে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে। কিন্তু রাজীব ইচ্ছাকৃত ভাবেই সব গুলিয়ে দেবেন, বিতর্কের নামে আবোলতাবোল বকে যাবেন। তাঁর রাগের প্রধান কারণ, শেল্ডন পোলক বহিরাগত। কলম্বিয়া, হার্ভার্ড, শিকাগোয় সেকুলারিজ্ম-এর চশমা এঁটে সংস্কৃত চর্চা হয়। এরা সংস্কৃতি বোঝে না, লৌকিক আর পরমার্থিককে সব সময় আলাদা করে দেয়। লৌকিক-ই গুরুত্ব পায়। কারণটাও আবিষ্কার করেছেন তিনি। সেকুলারিজ্ম, সোশাল সায়েন্স আর বামপন্থা একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ।

এই সব ভোঁতা তিরে ভর করে কতদূর আর যাওয়া যাবে! গান্ধার, পেশোয়ার বা জাভা, সুমাত্রায়ও যে সংস্কৃত ভাষা চলত, সেটি একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছেন রাজীব। শেল্ডন তাঁর দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য গড্স বইয়ে দেখিয়েছিলেন, বৈদিক স্তোত্র থেকে মুক্তি পেয়ে সংস্কৃত যখন রাজা ও পুরোহিতদের ক্ষমতার ভাষা হল, সংস্কৃত ভাষার বিশাল এক কসমোপলিস তৈরি হয়। রাজীব এই সব তত্ত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলে উঠতে পারেননি। শেল্ডন পোলক, ওয়েন্ডি ডোনিগেররা সকলে বহিরাগত, হিন্দু সভ্যতার কিছু বোঝেন না বলেই আর্যদের বহিরাগত বলেন, তপস্যারত শম্বুকের মাথা কেটে দেওয়ার রামচন্দ্রকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতা হিসেবে দেখান। কী ভাবে দেখা উচিত, সেটা অবশ্য তিনি বলে দিতে পারেননি।

ভূমিকাতেই বইয়ের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। শৃঙ্গেরী পীঠের ব্যবস্থাপনায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অধ্যাপক পদ তৈরির কথা হয়েছিল। স্পন্সররা অর্থ দেবেন, অ্যাকাডেমিক কমিটি ইন্টারভিউ নিয়ে ওই পদে যোগ্য লোককে নিয়োগ করবেন। শেল্ডন পোলক সেই কমিটির প্রধান। আমেরিকাবাসী রাজীব এর প্রতিবাদে জানালেন, শৃঙ্গেরী সারদাপীঠের ঐতিহ্যে লালিত হিন্দুই বসতে পারেন এই অধ্যাপক পদে। কিন্তু স্পন্সররা স্বাভাবিক ভাবেই পাত্তা দিলেন না। টেগোর প্রোফেসর হতে গেলে ব্রাহ্ম হতে হয় নাকি?

অগত্যা প্রিন্সটনের এক কাফেতে পোলকের সঙ্গে দেখা করলেন রাজীব। বললেন, হিন্দুরা শেল্ডনের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কে নামে না। পোলক বললেন, সেই দায়িত্ব তাঁর নয়। তিনি কাউকে তর্কযুদ্ধে নামতে বারণ করেননি। তার পরই ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। ১৬ পৃষ্ঠায় রাজীব সগর্বে জানাচ্ছেন, ‘ওঁর ছাত্র, বন্ধুরা কেন নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করে, জানতে চাইলাম।’ অর্থাৎ, শৃঙ্গেরী, সংস্কৃত— এ সবই গৌণ, আসল উদ্দেশ্য অন্য।

বই লেখার আগে রাজীব একটু সংস্কৃতটা পড়ে নিলে পারতেন, ‘অয়ং নিজঃ পরোবেতি গণনা লঘুচেতসাম্।’ ক্ষুদ্র হৃদয়ের লোকেরাই আপন-পর ভাগ করে থাকে। হিন্দু ধর্মটাও একটু পড়তে হত। শৃঙ্গেরীর সারদাপীঠকে হিন্দুর ভ্যাটিকান বলেছেন। দ্বৈতবাদী মাধ্ব, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ বা নাস্তিক চার্বাক তা হলে হিন্দু নন? ইতিহাসজ্ঞানও তথৈবচ। তাঁর বক্তব্য, সংস্কৃত আসলে ম্যান্ডারিন বা আরবির মতোই জীবন্ত ভাষা। চিনা আর সংস্কৃত ভাষার ইতিহাস যে আলাদা, উইলিয়াম জোন্স বা ম্যাক্সমুলারের মতো ‘বহিরাগত’রা না থাকলে সংস্কৃতের পুনরুত্থান নিয়ে এত মোটা বই লেখা যেত না সে সব এই মোদীভক্তকে কে বোঝাবে?

৩৪৪ পৃষ্ঠায় বহিরাগতদের সাহায্যকারী ঘরশত্রু বিভীষণদেরও চিনিয়ে দিয়েছেন রাজীব। শেল্ডন পোলক কেন বারংবার ইতিহাসবিদ ডি ডি কোশাম্বীর কথা বলেন? কোশাম্বীর প্রেরণাতেই ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, সুমিত সরকারদের মতো বামপন্থী ইতিহাসবিদ তৈরি হয়! বোঝা গেল, জ্ঞানের নাড়ি টনটনে। লেখক জানেন, শিবিরে ইতিহাসবিদ কম পড়িয়াছে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy