Advertisement
E-Paper

নিঃসঙ্গ প্রকৃতির কবি ইন্দ্র দুগার

ইন্দ্র দুগারেরও ছোটবেলা থেকে শিল্পের দিকে ঝোঁক, বাবার প্রভাবে ও প্রেরণায়। বাবাকে আঁকতে দেখেননি, কিন্তু তাঁর হাত ধরেই ছবি দেখা বা চেনার শুরু। হীরাচাঁদ যখন কলকাতা বা শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি নন্দলাল বসু-র ঘনিষ্ঠ শিষ্য।

অরুণ সেন

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
ভারত-দর্শন: বারাণসীর রাজাঘাট, ইন্দ্র দুগার অঙ্কিত। টিন্টেড কাগজে টেম্পেরা, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩। ছবি বই থেকে

ভারত-দর্শন: বারাণসীর রাজাঘাট, ইন্দ্র দুগার অঙ্কিত। টিন্টেড কাগজে টেম্পেরা, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩। ছবি বই থেকে

ইন্দ্র দুগার/ অপ্রকাশিত স্কেচে অজন্তা ও অন্যান্য

সম্পাদক: আশিস পাঠক

মূল্য: ১৫০০.০০

প্রকাশক: প্রতিক্ষণ

ইন্দ্র দুগার জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন না, কিন্তু শিল্পীসত্তার পরিচয়ে অবশ্যই বাংলার শিল্পকলার একজন। বেশ কয়েক শতাব্দী আগে, রাজস্থান থেকে এসে মুঘল আমলে, বস্তুত মুর্শিদকুলি খানের সময়ে, বাংলাদেশের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। মুর্শিদাবাদেরই ভাগীরথীর এপারে-ওপারে দুটি যমজ মফস্‌সল শহর আজিমগঞ্জ ও জিয়াগঞ্জের মধ্যে পূর্বের জিয়াগঞ্জে দুগারদের আবাসস্থল কয়েক পুরুষ ধরে। এঁদের মধ্যে ইন্দ্র-র বাবা হীরাচাঁদ দুগারই প্রথম শিল্পজগতে পদার্পণ করলেও প্রথাবদ্ধ শিল্পশিক্ষা পরিবারের কেউ করেননি। সকলেই তাঁরা জড়িয়ে থাকতেন পারিবারিক ব্যবসায়িক সাংসারিক কাজকর্মের মধ্যে। হীরাচাঁদ-ই প্রথম মাড়োয়ারি পরিবার থেকে কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পান। শান্তিনিকেতনের কলাভবনেও গিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য তাঁকে ফিরে যেতে হয় যথারীতি সওদাগরি খাতা লেখার কাজে।

ইন্দ্র দুগারেরও ছোটবেলা থেকে শিল্পের দিকে ঝোঁক, বাবার প্রভাবে ও প্রেরণায়। বাবাকে আঁকতে দেখেননি, কিন্তু তাঁর হাত ধরেই ছবি দেখা বা চেনার শুরু। হীরাচাঁদ যখন কলকাতা বা শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি নন্দলাল বসু-র ঘনিষ্ঠ শিষ্য। আর ইন্দ্র দুগারের কাছে তো বাবার সাহচর্য ছিল অমোঘ। তাঁরই মতো ল্যান্ডস্কেপে আগ্রহ এবং স্বচ্ছ বা অনচ্ছ জলরঙে পছন্দ— তা সে প্রকৃতিই হোক কিংবা মন্দির-স্থাপত্য। বাবাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন ইন্দ্র। তিনি একান্ত ভাবে মনে করতেন, শিল্পী হিসেবে তাঁর যেটুকু অর্জন তার উৎস তাঁর বাবা। বাবা ছিলেন, পুত্রের নিজেরই ভাষায়, ‘নিঃসঙ্গ প্রকৃতির কবি’। পরে দেখেছি, ইন্দ্র দুগারও তা-ই।

ছেলেকে হাতে ধরে নন্দলালের কাছে নিয়ে গেলেন বাবা। কোনও শিল্প-শিক্ষায়তনের ছাত্র নয়, তিনি হলেন বাবার গুরু নন্দলালেরই ব্যক্তিগত নিভৃত ছাত্র। বাড়িতে ছবি এঁকে নিয়ে যেতেন। তত দিনে তিনি বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে স্কেচ এঁকে চলেছেন অজস্র— তা সে জন্মস্থান জিয়াগঞ্জের নদী মাঝি গাছ-ফুল-ফল যা-ই হোক কিংবা শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি— সেই স্কেচভর্তি খাতা দেখে নন্দলাল তাঁকে অনেক উপদেশ-পরামর্শ দিতেন, এবং শুধু ছবির কৃৎকৌশলে নয়, পরিচিত করাতেন জীবন ও শিল্পের বৃহত্তর ভাবনায়। তাই তো তাঁর কাছে একদা ইন্দ্র দুগার শিল্পশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রার বাসনা প্রকাশ করে তিরস্কৃত হন। নন্দলাল বলতেন, নিজের দেশ ও তার শিল্পকে চেনাই প্রথম কাজ। পরে দেখেছি, যেন সেই আদর্শেই ইন্দ্র দুগার প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজগির, পাওয়াপুরী, রাজস্থান (বিশেষ করে যোধপুর) এমনকী কাশ্মীর— সেখানকার নিসর্গ ও মানুষের ছবি তাঁর খাতায় অবিরল। গুরু ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন অজিন্ঠা, ইলোরা, কোনারক বা বিভিন্ন জৈন তীর্থে যাওয়ার। এ সবই ছিল ইন্দ্র দুগারের ভারত-দর্শন ও ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প-চর্চার লক্ষ্য।

দুটি স্কেচবুকে ইন্দ্র দুগার তাঁর এই ভারত-ভ্রমণের চিত্র-অভিজ্ঞতা ভরে রেখেছেন। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৯ থেকে ১২ জানুয়ারি ১৯৭০ পর্যন্ত ইন্দ্র ছিলেন অজিন্ঠায়— স্কেচবুকের প্রথমটিতে গোড়াতেই ২৬ পাতা জুড়ে সেই ১৩ দিনের শিল্পকর্ম। সেখানকার ভূদৃশ্য, অজিন্ঠাগুহার চিত্র ও ভাস্কর্য, চারপাশের মানুষজন। ৫৭ বছর আগে অসিত হালদার ও নন্দলাল বসু অজিন্ঠার চিত্র-প্রতিলিপি আঁকতে গিয়েছিলেন, এবং ফিরে এসে অসিত হালদারের অজন্তা নামের বিখ্যাত গদ্যের বইটি বেরোয়, যা আজও পঠিত (এবং পুনর্মুদ্রিত)। আগেই তো জেনেছি, ইন্দ্র দুগারও গিয়েছিলেন তাঁদেরই প্রণোদনায়। তবে তিনি বই লেখেননি, যদিও তাঁর উপর তাঁদের প্রভাবের ছাপ রয়েছে অনেক। অজিন্ঠার-চিত্রণেই শেষ নয়, প্রথম স্কেচবুকে অজিন্ঠার সূর্যোদয়, উঁচুনিচু জমি, অসংখ্য স্থানীয় নরনারী, তাদের চলার-বসার-হাঁটার ভঙ্গি, নিত্যযাপনের চিহ্ন, তাদের পোশাকের ভাঁজ কিংবা অন্য দিকে গুহার প্রত্ন-মূর্তি ও অবয়ব, ভারতীয় শিল্পের ষড়ঙ্গ, হাত বা আঙুলের মুদ্রা ও তার ছন্দ; পাশাপাশি একই সঙ্গে উচ্চার্য শিল্পমন্দির ইলোরারও পরিবেশ-প্রকৃতি, ভাস্কর্য-প্রতিলিপি, নৃত্যভঙ্গিমা, শৃঙ্গারদৃশ্য ইত্যাদি। ইন্দ্র দুগার যেটুকু পেয়েছেন অবনীন্দ্রনাথের লেখায় শারীরিক আকৃতি ও প্রকৃতি কিংবা ভাব ও ভঙ্গির শিক্ষায় কিংবা নন্দলালের লেখায় ‘শিল্পে শারীরস্থান বিদ্যার প্রয়োগে’। তবে লক্ষণীয়, শুধুই চিত্রময় হলেও মাঝে-মাঝেই স্কেচের আশেপাশে বিবরণী বা মন্তব্যে চিন্তাজগতেরও আভাস মেলে। অতঃপর প্রথম স্কেচবুকেও এগোলে দেখা যায়, অজিন্ঠা-ইলোরা থেকে আরও নানা স্থানের অভিজ্ঞতা এসেছে তাঁর চিত্রশালায়। সবচেয়ে বেশি জন্মভূমি জিয়াগঞ্জের দৃশ্যাবলি। জিয়াগঞ্জের পাশে গঙ্গা, নদীর বাঁক, কত রকমের নৌকো, স্নানঘাটের সমারোহ, এখানেও ভিন্ন-ভিন্ন মানুষ ও তাদের পরনের বা চলনের বৈচিত্র্য, উবু হয়ে বা ঝুঁকে পড়ে তাদের চুলে বিনুনি দেওয়া বা হাতে মেহেদি লাগানো, গ্রামে গাছের তলায় খড়বোঝাই গোরুর গাড়ি, শুধু তা-ই নয়, গাছের কাণ্ড ও ডালপালা, গাছের পাতা আর ফুল ও ফল। দ্বিতীয় স্কেচবুকের সময়কাল ১৯৮২-র ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ নভেম্বর। সেটি প্রায় সম্পূর্ণতই কাশ্মীরের বা কখনও জম্মু-র প্রকৃতি ও মানুষের স্কেচ। সেখানকার প্রকৃতি ও জনপদ, বাড়িঘর, চেনা মানুষের গায়ে পশমের বিশিষ্ট পোশাক ও টুপি, নদী ও লেক, নৌকো ও শিকারা— পহেলগাঁও-ই হোক কিংবা গুলমার্গ বা হয়তো শ্রীনগর— ইন্দ্র দুগারের পেন্সিলে বা কলমে বা তুলির রঙে।

এই দুটি স্কেচের খাতা নিয়েই প্রতিক্ষণ প্রকাশিত অ্যালবাম অপ্রকাশিত স্কেচে অজন্তা ও অন্যান্য। অজিন্ঠার ওপর যে জোরটুকু পড়ে, তা খুবই স্বাভাবিক। মনে পড়ে, অনেককাল পরে গণেশ হালুইয়ের অপ্রকাশিত কাজের নির্বাচনেও তাঁর অজিন্ঠার-র ভাবনা ও শিল্পের পুনরুদ্ধারের কথা তুলেছিলেন প্রকাশ দাস। এখানে প্রথমেই আশিস পাঠকের সম্পাদনায় ‘কথামুখ’ অংশে ইন্দ্র দুগারের জীবন ও কৃতির পরিচয় প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠক-দর্শককে যে ভাবে প্রস্তুত করে, এবং সেই সূত্রে তাঁর অজিন্ঠার প্রসঙ্গের আধুনিকতা তাঁর শিল্পবিচারে ফুটে ওঠে, তা অসামান্য। তদুপরি শিল্প-বিষয়ক গ্রন্থপ্রকাশনে প্রতিক্ষণ-এর দীর্ঘকালের সুনামের সাক্ষ্য গ্রন্থ-পরিকল্পনায় ও অঙ্গসজ্জায় আবারও প্রমাণিত। সেই সঙ্গে আছে ইন্দ্র দুগারের নিজের লেখা থেকে বেশ কয়েকটি গদ্যাংশের সংকলন (তার মধ্যে এমনকী ‘লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চি’, ‘যামিনী রায়’,‘আচার্য নন্দলাল’, ‘ক্যালকাটা গ্রুপের প্রদর্শনী’, ‘আমার কলকাতা’ ইত্যাদি) এবং গ্রন্থশেষে নারায়ণ সান্যাল, সুনীলকুমার পাল, রথীন মৈত্র, দ্বিজেন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, সন্দীপ সরকার প্রমুখের লেখা ইন্দ্র দুগারের ‘ব্যক্তি ও শিল্প’ বিষয়ে। এ-ব্যাপারেও আশিস পাঠকের কৃতিত্ব স্বীকৃত। অজস্র স্কেচ তো বটেই, অ্যালবামের শেষে পারিবারিক সংগ্রহ থেকে সংগৃহীত কতকগুলি বহুরঙা ছবিও আছে— তাঁর নিজস্ব টেম্পেরা, ওয়াশ, জলরঙ, এবং ক্বচিৎ তেলরঙে।

Book Review পুস্তক পরিচয় ইন্দ্র দুগার Indra Dugar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy